দেশের খুচরা বাজারে ‘বৈধ-অবৈধ সহাবস্থানে’ চলছে রমরমা ওষুধ ব্যবসা। অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত ওষুধের দোকানের ছড়াছড়ি থাকলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ফার্মেসির অর্ধেকেরই ওষুধ বিক্রির অনুমতি নেই।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত ফার্মেসির সংখ্যা ২ লাখ ২৬ হাজার ১১৮। এর মধ্যে অর্ধেকের নিবন্ধন নেই। আবার নিবন্ধন আছে, এমন এক লাখের মতো ফার্মেসি ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি।
এর বাইরে আড়াই লাখের মতো ফার্মেসির ওষুধ বিক্রির কোনো অনুমতিই নেই। আর এমন অবৈধ ফার্মেসি ঢাকাতেই আছে প্রায় এক লাখ।
২০২১ সালে জাতীয় সংসদে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশে চিহ্নিত লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান ১২ হাজার ৫৯২টি। কিন্তু এর প্রকৃত সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি বলেন, ‘ড্রাগ লাইসেন্স পেতে অনেক ঝামেলা। তাই নেই না। প্রশাসনের লোক এলে “যা দেওয়ার দিয়ে দেই।” সবাই তো এভাবেই “ম্যানেজ” করে চলছে।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ‘বৈধ-অবৈধ সহাবস্থানের’ ফার্মেসি থেকে দেশের মানুষ কার্যত সেবা থেকে বঞ্চিত। ওষুধের দোকানে নেই পেশাদার ফার্মাসিস্ট, নেই ওষুধ সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাও। ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর তৈরি হচ্ছে মারাত্মক ঝুঁকি।
আবার অনেকে এসব অনভিজ্ঞদের ওপর ভরসা করে চিকিৎসাপত্র ছাড়াই অসুখ-বিসুখে সেবন করছেন ওষুধ। এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে আরও।
জানা গেছে, ফার্মেসির লাইসেন্স পাওয়ার নিয়ম যেমন কঠিন, তেমনি কঠোর। ‘মডেল ফার্মেসি’ চালাতে হলে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট, নির্ধারিত আয়তনের দোকান, ভ্রাম্যমাণ ফ্রিজ, সংরক্ষণের উপযোগী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ট্রেড লাইসেন্সসহ একগুচ্ছ শর্ত। তবে এসব লাইসেন্স এবং নবায়নের ফি খুব বেশি নয়।

এ বিষয়ে ১৯৪০-এর দশকের দুটি আইন রয়েছে। ১৯৪২ সালের ড্রাগ অ্যাক্ট ও ১৯৪৫ সালের রুলস অনুসারে ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা অপরাধ। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুর রহমান টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘কোনো দেশের ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্সের ঘনত্ব দেখে সে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যে ফার্মাসিস্টের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। উত্তর আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) ও ইউরোপের দেশসমূহে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টের অনুপাত প্রায় ৩:১। জাপানে এটি প্রায় ১:১। বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টের ঘনত্ব প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।’
‘বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টের ঘনত্ব প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। ২২ হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকলেও অধিকাংশই রয়েছেন শিল্পখাতে। ফার্মেসিতে কাজ করছেন খুবই কম। কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট এবং হসপিটাল ফার্মাসিস্ট মিলিয়ে সংখ্যা ২০০-৩০০-এর বেশি হবে না। অর্থাৎ, দেশের জনগণ ফার্মাসিস্টের সেবা থেকে প্রায় পুরোপুরি বঞ্চিত,’ যোগ করেন তিনি।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমেদ পারভেজ বলেন, ‘আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সক্ষমতা আছে। তাদের উচিত হবে মনিটরিং বৃদ্ধি করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ফার্মেসিতে মানসম্মত ওষুধের ব্যবস্থা নি করা।’
‘পাশাপাশি যারা নিবন্ধন পেয়েছেন তারা কেন পেলেন, আর যারা পাননি, কেন পাননি– তার তুলনামূলক পার্থক্য তাদেরকে বোঝানো’, উল্লেখ করেন তিনি।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার ‘ফার্মেসি নেটওয়ার্ক’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ৭০০ মানসম্পন্ন ফার্মেসির নেটওয়ার্ক তৈরি করা হবে। হাসপাতালভিত্তিক ফার্মেসিগুলোকে করা হবে আধুনিক।
পাশাপাশি অবৈধ বা নিবন্ধন না থাকা ফার্মেসিগুলোর বিরুদ্ধে নতুন করে ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেন জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও লাইসেন্স নবায়ন না করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।