বিদায় ‘সুপারম্যান’ ম্যাথুস

টাইমস স্পোর্টস
6 Min Read
ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টের শেষ ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়ছেন ম্যাথুস। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

মুশফিকুর রহিমের সাথে সেকেন্ড ত্রিশেকের একটা হাসিখুশি আড্ডা। পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন দীনেশ চান্দিমাল। শেষদিকে মজার ছলে মুশফিকের দাঁড়ি ধরে কিছু একটা বললেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। মুশফিকও হেসে দুই হাতে তার হেলমেটে নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন। থার্ড আম্পায়ার তখন জায়ান্ট স্ক্রিনে জানিয়ে দিলেন ‘নট আউট’।

মুশফিক-ম্যাথুসের ছোট্ট সেই আড্ডাটা জমেছিল বাংলাদেশ-শ্রীলংকার গল টেস্টের পঞ্চম দিনের শেষ সেশনে, ম্যাথুসের বিপক্ষে বাংলাদেশ অধিনায়ক লেগ বিফোরের রিভিউ নেয়ার সময়টায়। শ্রীলংকার দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯-তম ওভারে তাইজুল ইসলামের বল ম্যাথুসের প্যাডে লেগে জোরালো আবেদন হয়। রিভিউতে দেখা যায় বল পিচ করেছে লেগ স্টাম্পের বাইরে। সেই যাত্রায় ম্যাথুস বেঁচে গেলেও পরের বলে আর রক্ষা হয়নি। তাইজুলের ফুল লেংথ বল টার্ন করে ব্যাটের কানা ছুঁয়ে প্যাডে লেগে জমা পড়ে সিলি মিড অফে মুমিনুলের হাতে। ডানে ঝাপিয়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচে ম্যাথুসের শেষ টেস্ট ইনিংসটা থামিয়ে দেন মুমিনুল। 

শেষ বেলায় মুশফিকের সাথে ছোট্ট আড্ডা। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

নিজেরা খানিকটা উদযাপন করলেও ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটা শুরু করা ম্যাথুসের কাছে একে একে ছুটে যান লিটন দাস, মুশফিকুর রহিম, নাঈম হাসানরা। উইকেট ব্রেকে পানি নিয়ে মাঠে ঢুকতে গিয়ে এবাদত হোসেনও জড়িয়ে ধরেন ম্যাথুসকে। এভাবেই টেস্ট ক্রিকেটে শেষটা হলো তার। ৩৮ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেট ছাড়লেন শ্রীলংকার সেরা ব্যাটারদের একজন হয়ে। ইনজুরির সমস্যা তো ছিলই, বোর্ডের সাথে বিবাদে না জড়ালে ক্যারিয়ার হয়তো শেষ করতে পারতেন দেশের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবেও। 

বাংলাদেশ দলের অভিবাদন ম্যাথুসকে। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

ভারত মহাসাগর ঘেষা গলেই তার টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু, শেষটাও হলো গলে। মাঝে শততম টেস্টও ম্যাথুস খেলেছেন ঐতিহাসিক গল দুর্গ লাগোয়া মাঠে।  শ্রীলংকা ক্রিকেট বোর্ডের আয়োজনে মাঠের চারপাশে বসানো ব্যানারেও ফুটে উঠল গল আর ম্যাথুসের এক সুতোয় গাঁথা গল্পের টুকরো ছবিগুলো,  ‘ফ্রম ডেব্যু টু ফেয়ারয়েল, অ্যাঞ্জেলো’

ম্যাথুসের বিদায় ঘিরে কমতি ছিল না আয়োজনের। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

যেহেতু আগেই জানিয়েছেন এখানেই ১৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ পাতাটা উল্টাবেন,  তাই শ্রীলংকা ক্রিকেট বোর্ডও তাকে বিদায়ের আয়োজনে কার্পণ্য করেনি। গল টেস্টের প্রথমদিন টসের পর জাতীয় সংগীতের পর্ব সেরে তার হাতে বিশেষ সম্মাননা তুলে দিয়েছেন লংকান বোর্ডের দুই কর্তা।  ফিল্ডিং করতে মাঠে নামার সময় সতীর্থদের কাছ থেকে পেয়েছেন গার্ড অফ অনার। বিদায় বেলার শুরুতে মাঠে ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরাও। বাংলাদেশের শান্ত-মুশফিকরা ছুটে গিয়েছেন তাকে অভিনন্দন জানাতে। বাউন্ডারি লাইনের কাছে কিশোর ক্রিকেটাররা দুই সারিতে দাঁড়িয়ে ব্যাট তুলে ধরে দিয়েছেন সম্মাননা।এখানেই শেষ নয়,  প্রথম ইনিংস ব্যাট করতে নেমে পেয়েছেন গোটা বাংলাদেশ দল আর দুই অনফিল্ড আম্পায়ার এলেক্স হোয়ার্ফ আর রড টাকারের গার্ড অফ অনার। ম্যাচ শেষে ছুটে গেছেন মাঠ লাগোয়া গ্যালারিতে দর্শকদের কাছে। খেলা দেখতে আসা ক্রিকেটপ্রেমীরাও ছুঁয়ে দেখলেন ম্যাথুসকে। মাঠ ছেড়েছেন দুই সতীর্থের কাঁধে চড়ে।

গার্ড অফ অনার। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

এত সম্মাননা, এত আয়োজন আর আড়ম্বর, সবই ম্যাথুস পেয়েছেন লাল বলের ক্রিকেটে তার অসামান্য অর্জনের জন্য। দেশের হয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ ১১৯টি ম্যাচ খেলে করেছেন তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮২১৪ রান। ১৬ সেঞ্চুরি করা ম্যাথুস শ্রীলংকার সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়কও বটে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩টি টেস্ট তার অধীনে জিতেছে শ্রীলংকা। পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়েও ম্যাথুসকে বিচারের সুযোগ আছে। জেনুইন অলরাউন্ডার হওয়ার মতো সব গুণাগুণই তার মধ্যে ছিল। পেস বোলিং অলরাউন্ডাররা যখন দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই ম্যাথুসের উত্থান। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ব্যাটিং বেশি সময় দিতে গিয়ে ক্রমেই হারিয়ে গেছে তার বোলিং সত্তা। 

টেস্টের প্রতি কতটা নিবেদিত ছিলেন ম্যাথুস? ২০১৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে আবুধাবি টেস্টে সাড়ে সাত ঘণ্টা একাই ব্যাট করেছিলেন এই ডানহাতি। উদ্দেশ্য দলের হয়ে ম্যাচ বাঁচানো। ১৫৭* রানের ইনিংস খেলে সেই টেস্ট ড্র করিয়েছিলেন ম্যাথুস। ২০১৪ সালে হেডিংলির ১৬০ রানের ইনিংসে ইংল্যান্ডে ১৬ বছরের জয় খরা কাটানো কিংবা ২০১৮ সালে ওয়েলিংটনে সাত ঘন্টার আরো একটা ম্যারাথন ইনিংসে সেঞ্চুরির পর দশটা পুশ আপ দিয়ে মাসল ফুলিয়ে কোচকে দেখিয়ে দেয়া তিনি ক্রিকেটের জন্য ‘আনফিট’ নন। এসবই সাক্ষ্য দেয় লাল বলের ক্রিকেটকে ঠিক কতটা ভালোবাসতেন তিনি। 

টেস্ট শুরুর আগে সম্মাননা স্বারক পেয়েছেন ম্যাথুস। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

অবশ্য তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়ার্ধে ইনজুরির জন্য তেমন বলার মতো কিছু করতে পারেননি। নিজেও কদিন আগে বলেছেন সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। তরুণদের জনহ্য এই জায়গাটা ছেড়ে দিতে পারলেই তিনি খুশি। ঠিক সময়ে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারাও ক্রিকেটারদের একটা অনন্য গুণই বটে। 

ক্যারিয়ার যখন শুরু করেন, তখন বলেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্সের মতো ক্রিকেটার হতে চান। রানে স্যার সোবার্সকে ছাড়িয়ে গেলেও উইকেটে পারেননি। জেনুইন অলরাউন্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারেননি, তবে স্যার সোবার্সের মতো কেউ হওয়ার সেই ইচ্ছে আর করে দেখানোর মানসিকতা ছিল বলেই এত আড়ম্বরে বিদায় নিয়েছেন ম্যাথুস টেস্টের বিশাল মঞ্চ থেকে। 

প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে পেয়েছেন বাংলাদেশের গার্ড অফ অনার। ছবি: শ্রীলংকা ক্রিকেট

কলম্বোর সেন্ট জোসেফ কলেজে থাকতে বন্ধুরা মজা করতে ডাকতেন ‘Jocka’ বলে। সেই নামকরণ হয়েছিল ট্রাউজারের নিচে থাকা টাইটসের ওপর আন্ডারওয়্যার পরতেন বলে। শ্রীলংকার ড্রেসিংরুমে এই গল্প ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগেনি। তার সতীর্থরা এক কাঠি সরেসই ছিলেন বটে। নইলে ডিসি কমিকসের সুপারহিরোর আদলে ‘সুপারম্যান’ বলে ডাকতেন না! 

এবার টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাথুসের কীর্তিগুলো মনে করুন তো, শ্রীলংকার সুপারম্যান তো তাকে বলাই যায়, নাকি?

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *