প্রকাশ্য বিরোধে বিএনপি-জামায়াত

টাইমস রিপোর্ট
4 Min Read
Highlights
  • ‘বিভিন্ন কারণে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তারা কখনোই সরকার গঠন করতে পারবে না। এ কারণেই তারা নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়, বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়াচ্ছে।’

দেশের অন্যতম দুই রাজনৈতিক শক্তি–বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা একে অপরকে নিয়মিতভাবে আক্রমণ করছে। এমনকি সেই আক্রমণ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে।

বিএনপি আবারও পুরনো স্লোগান ফিরিয়ে এনেছে, জামায়াতকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য ‘রাজাকার’ বলে আখ্যায়িত করছে। অন্যদিকে, পাল্টা অভিযোগ এনেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে—খুন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছে জামায়াত।

এই বিরোধ এখন শুধু কথার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার, বিশেষ করে নির্বাচনসংক্রান্ত সিদ্ধান্তে দুই দলের অবস্থানও বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে।

এক সময়ে এই দুই দল ছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় তৈরি করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট, যারা বহু বছর ধরে সরকার গঠন ও নির্বাচনী রাজনীতিতে একসঙ্গে পথ চলেছে।

এই জোটের ভিত্তি তৈরি হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক শূন্যতায় জিয়া বিভিন্ন আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিকে একত্রিত করতে উদ্যোগী হন।

এর মধ্যে জামায়াতের নেতারাও ছিলেন, যাদের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়া ১৯৭৯ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দেন।

এ ছাড়া, যুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুমতি দেন জিয়া। পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশি নাগরিকত্বও দেওয়া হয়।

এই জোট উভয় দলের জন্য লাভজনক ছিল। জিয়া জামায়াতসহ অন্যান্য ডানপন্থী দলকে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বর্ণনার পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে ব্যবহার করেন। জামায়াতও বিএনপির ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক বৈধতা ফিরে পায়।

এই সম্পর্ক পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী জোটে পরিণত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন, যেখানে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট গঠন করে নিরঙ্কুশ জয় পায়। সেই নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসন পায় এবং শিল্প ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুটি দায়িত্বও পায়, যা জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থানকে আরও মজবুত করে।

তবে মধ্য-নব্বই দশকে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর জামায়াত আশ্চর্যজনকভাবে বিএনপির বিপক্ষে গিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একযোগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হয়।

এই ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ পরও ২০০১ সালের মধ্যে আবার একত্রিত হয় বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে সম্পর্ক আবার অবনতির দিকে যায়। আওয়ামী লীগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে, জামায়াতের অনেক নেতাকে ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য ফাঁসিতে জোলানো হয়।

এই চাপের মুখে বিএনপি ধীরে ধীরে জামায়াত থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের কোনো প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জোটের অংশ হিসেবে মনোনয়ন দেয়নি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর দুই দল আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে দুই দলের শীর্ষ নেতারা এই ক্রমবর্ধমান বৈরিতা লুকাতে চেয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস টাইমস অব বাংলাদেশ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তারা কখনোই সরকার গঠন করতে পারবে না। এ কারণেই তারা নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়, বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়াচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াত কখনো ১৯৭১ সাল এবং মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেনি। এজন্যই দেশের মানুষ কখনো তাদের গ্রহণ করেনি। বিপরীতে, বিএনপি একটি মুক্তিযুদ্ধের দল, এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর। এখন সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে।’

অন্যদিকে, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘রাজনীতিতে বিরোধিতা নতুন কিছু নয়। আমরা ১৭ বছর এক সঙ্গে ছিলাম, এক সঙ্গে শেখ হাসিনাকে হটানোর আন্দোলন করেছি। এখন আমরা আলাদা রাজনৈতিক পথে হাঁটছি। একে অপরের বক্তব্য পছন্দ নাও করতে পারি।’

২০২৪ সালের আগস্টে নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্ব আর লুকিয়ে নেই। এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোগীরা এখন প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। উভয় দলই নতুন বাস্তবতায় নিজেদের অবস্থান নতুনভাবে ঠিক করার চেষ্টা করছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *