দেশজুড়ে ক্রমেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়তে থাকায় নতুন করে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণ বৃদ্ধির এই প্রবণতা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে নয়, গুরুতর এই ফৌজদারি অপরাধ আইনশৃঙ্খলার অবনতির পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির অশনি সংকেতও বহন করে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪৯২টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। আর ২০২৪ সালে পুরো বছরে এই সংখ্যা ছিল ৪০১টি। অর্থাৎ মাত্র সাত মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা গত এক বছরের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৩ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭৪টি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে তারা ৩৫৪টি ধর্ষণের ঘটনা শনাক্ত করেছে, যা ২০২৪ সালের প্রায় সমান (৩৬৪টি)। ২০২৩ সালে ধর্ষণ হয়েছে ৬৩৯টি, যার মধ্যে ৪৩১ জনই ছিল শিশু।
নারীবিদ্বেষ প্রচার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ সমাজে নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, দুর্বল আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. মালেকা বানু বলেন, ‘বর্তমানে একটি সংগঠিত নারীবিরোধী প্রচারণা নারী বিদ্বেষকে আরো উস্কে দিচ্ছে। নারীদের পোশাক, চলাফেরা, এমনকি নারীর স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করা হচ্ছে। একারণে সামাজিক মাধ্যমে তো বটেই, এমনকি রাস্তাঘাটে নারীকে অপমান, হয়রানি ও মারধরের ঘটনাও ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘অপরাধীরা অনেক সময় কোনো শাস্তি পায় না। এজন্য তারা আরও সাহসী হয়ে ওঠেন। বিচারের অভাবে অনেক মামলাই ঝুলে থাকে।’
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ধর্ষণের শিকার একটি বড় অংশ দরিদ্র শ্রেণীর নারী ও শিশু। সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থাকায় তাদের আইনের সুরক্ষা নেওয়া কঠিন।
পরিচিতরাই ধর্ষক
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি জরিপে দেখা গেছে, শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনায় বেশিরভাগ অপরাধীই ভুক্তভোগীর পরিচিত।
মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, সন্দেহভাজন ধর্ষকের মধ্যে ২৮ শতাংশের বয়স ১১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আর বেশিভাগ অভিযুক্ত ধর্ষকের বয়স ২১ থেকে ২৫ বছর।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া এবং অল্প সংখ্যক অপরাধীর শাস্তি পাওয়ার কারণে এই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ও লিঙ্গ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ‘দেশে অনেক ভালো আইন আছে, কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। এজন্য নারীরা নিরাপদ নন।’
তিনি বলেন, ‘দেশে যখন রাজনৈতিক সংকট বা অস্থিরতা বিরাজ করে, তখন আইন-শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে নারী ও শিশুরা।’
সামাজিক মাধ্যমে নারীবিদ্বেষী ও সহিংসমূলক প্রচারণা প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক তানিয়া বলেন, ‘এই সব মন্তব্য সমাজে নারীদের প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে তোলে। তাই ক্ষতিকর কনটেন্টের উপর নজরদারি জরুরি।’
পরিবার ও শিক্ষায় চাই পরিবর্তন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। দরকার সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন।
অধ্যাপক তানিয়া মনে করেন, পরিবর্তন শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের পারস্পরিক সম্মান আর সমতা শেখাতে হবে। এ জন্য শিশুশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
বিচারে দীর্ঘসূত্রতা
অনেক সময় দেখা যায়, লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের শিকার নারী মামলা করতে চান না। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়াও এর কারণ।
ড. মালেকা বানু জানান, অনেকেই মান-সন্মানের ভয়ে পুলিশ বা আদালতের কাছে যান না। একারণে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের একটি বড় অংশ রেকর্ডভুক্ত হয় না।
তিনি বলেন, ‘আইন থাকলেও বাস্তবে কার্যকর না হলে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা চলতেই থাকবে।’
‘আমাদের এমন একটি সরকার দরকার, যারা নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না,’ যোগ করেন তিনি।