রাজনীতির ভাষা যখন যুক্তি থেকে সরে যায়, তখন শব্দ হয়ে ওঠে ছায়ার ছায়া, অভিযোগ হয়ে দাঁড়ায় আরো ধোঁয়াশা। রাজনৈতিক চশমায় প্রযুক্তি যখন আতঙ্কের—তখন স্যাটেলাইট মানেই ‘নজরদারি’, অবাধ তথ্য-প্রবাহ মানেই ‘ষড়যন্ত্র’।
একবিংশ শতাব্দির সাইবার বিশ্বের যুগে এমন মনস্তত্ত্ব হাস্যকর হলেও বাংলাদেশ এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে কিছুটা পরিচিত।
বুধবার নয়াপল্টনে ‘তারুণ্যের সমাবেশে’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ”স্টারলিংক’ ছাড়া চলেছি, ওয়াইফাই ছাড়াও চলেছি। দেশ ভালোই ছিল। ‘স্টারলিংক’ আনছেন কার জন্য? আনছেন আরাকান আর্মির জন্য। করিডোর কার জন্য, এখান দিয়ে আরাকান আর্মির মাল-মশলার জন্য। সেন্টমার্টিন কার জন্য, বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য!’

একি বললেন মির্জা আব্বাস!
মহাশূন্যে ভাসমান এক বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা নাকি হয়ে উঠবে সীমান্ত ওপারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর রসদ যোগানের মাধ্যম! ‘আরাকান আর্মি, করিডোর ও সেন্ট মার্টিন’—এসব বিষয় অবশ্যই কূটনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব রাখে। কিন্তু একই চক্রে প্রযুক্তির অন্তর্ভূক্তি মারাত্মক আত্মঘাতী।
তবে তার ওই উক্তি নিছক রাজনৈতিক বাক্য নয়, এটি এক ধরণের প্রযুক্তি-ভীতির বহিঃপ্রকাশ, যার পেছনে আছে অজানা ভবিষ্যতের সঙ্গে আতঙ্কের মিশ্রন।
প্রশ্ন হচ্ছে, চতুর্থ মাত্রার সমান্তরাল সাইবার বিশ্বের বিপরীতে আমরা কি এখনও সেই ১৯৯৫ সালের পুরনো সময়ে আটকে রয়েছি?
নব্বইয়ের দশকে বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশের সংযুক্ত না হওয়ার পেছনে সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের অন্যতম যুক্তি ছিল, সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হলে বাংলাদেশ থেকে নাকি ইন্টারনেটে সহজেই সব রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য বিদেশে পাচার হয়ে যাবে!

পরে বাংলাদেশকে ওই ‘মহাভুলের’ মাশুল গুনতে হয়েছে বছর দশেক। আর সাবমেরিন ক্যাবলে এদেশকে যুক্ত হতে হয়েছে উচ্চমূল্যের রাজস্ব ব্যয় করেই।
তখন প্রযুক্তিগত অজ্ঞতা আমাদেরকে এক দশক পিছিয়ে দিয়েছিল। ভুতেরা নাকি পেছন দিকে হাঁটে। আমরা কি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগুব? নাকি ভুতের পা ধার করে হাঁটব পেছনের দিকে?
বাংলাদেশে ‘স্টারলিংকের’ যাত্রার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়েছিল আগেই। কিন্তু বিগত হাসিনা সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কিছু ‘পলকসুলভ’ চৌর্যবৃত্তির প্রয়াসে তা আটকে গিয়েছিল।
কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর মুক্ত আবহে অন্তর্বর্তী সরকার ‘স্টারলিংক’কে অনুমোদন দিয়েছে; আর সম্ভবত এই প্রথম এত বড় কোনো আন্তর্জাতিক প্রযুক্তির কোম্পানি এদেশে যাত্রা শুরু করেছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, কোনো ‘কমিশন বাণিজ্য’ ছাড়াই।
তাহলে ‘করিডোর দিয়ে মাল-মশলা পাচার আতঙ্কের’ সঙ্গে ‘স্টারলিংকে’ আরাকান আর্মির রসদ পাচারের আতঙ্ক গুলিয়ে ফেলা কেন? অবশ্য তথ্য পাচার, গোপন নজরদারি, বিদেশি প্রভাব—এসব আশঙ্কা কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষকের নয়।
এই আশঙ্কা একজন প্রবীণ রাজনীতিকের কাছ থেকে এমন সময় এসেছে, যখন একই ‘তারুণ্যের সমাবেশে’ লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সুদূর ব্রিটেন থেকে তার ওই বক্তব্য উত্তর আটলান্টিক, লোহিত, আরব, ভারত ও বঙ্গোপসাগর– এই পাঁচ-পাঁচটি সমুদ্র এবং মাত্র চার হাজার ৯৬৫ মাইল পেরিয়ে মুহূর্তেই সম্প্রচার হয়। যে বক্তব্যে তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের দিক-নির্দেশনা দেন এবং দাবি জানান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের।
এই দ্বিচারিতা শুধু ‘সুবিধাবাদ’ নয়, এটি আসলে চিন্তারই প্রতিবন্ধকতা, রক্ষণশীল মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ; যেখানে প্রযুক্তির শক্তিই ভীতিকর, আর রাজনৈতিক পরিভাষা একে দাঁড় করায় কথামালার রাজনীতিতে।
বিশ্ব এখন তথ্য-প্রযুক্তিকে মুঠোবন্দি করার যুগে। আর এ সময় যে দেশ অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে গ্রহণ করবে না, সে দেশ পিছিয়ে পড়বে অবাধ তথ্য প্রবাহ থেকে তো বটেই, এমনকি রাজনীতি ও অর্থনীতি থেকেই। আর ‘স্টারলিংক’ মানে শুধু উচ্চগতির ইন্টারনেট নয়—এই সংযোগের অর্থ হচ্ছে দুর্গম জনপদে স্বাস্থ্যসেবা, প্রত্যন্ত গ্রামে অনলাইন শিক্ষা, তরুণ উদ্যোক্তার হাতে নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা।
কাজেই কথা লাউড এন্ড ক্লিয়ার: বাংলাদেশে ‘স্টারলিংক’ বন্ধ করতে চাইলে, আমরা শুধু একটি সংস্থাকে নয়, নিজেদের ভবিষ্যতের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেব। আরেকবার ফিরে যাব ১৯৯৫ সালের ‘মহাভুলের’ পরিণতিতে।