কিংবদন্তি শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের ৯০ তম জন্মদিন সোমবার (১ সেপ্টেম্বর)। ১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর যশোর জেলায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পৈত্রিক নিবাস ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে। তার বাবা প্রয়াত কবি গোলাম মোস্তফা এবং মায়ের নাম জমিলা খাতুন।
বাংলাদেশে পাপেট শিল্পের বিকাশ ও টেলিভিশন নাটকে তার কৃতিত্ব অতুলনীয়। বিটিভি থেকে প্রচারিত শিশু প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে জনপ্রিয় ‘নতুন কুড়ি’র রূপকার তিনি।
মুস্তাফা মনোয়ারের শিক্ষা জীবনের শুরু কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে। এই স্কুলে পড়ার সময় তিনি বাবা ও বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সঙ্গীতের তালিম নেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হন তখন নতুন করে আবার সঙ্গীতে মনোযোগী হন। তালিম নেন ওস্তাদ ফাইয়াজ খানের শিষ্য ওস্তাদ সন্তোষ রায়ের কাছে। দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলে প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর দলে। কিন্তু ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহের কারণে কণ্ঠসঙ্গীতে আর নিয়মিত হতে পারেননি।
ভাষা আন্দোলনের সময় মুস্তাফা মনোয়ার নবম শ্রেণির ছাত্র, পড়ছিলেন নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে। সেই কৈশোরেও ভাষার প্রশ্নে উদ্বেলিত হলেন তিনি। যখন শুনলেন ঢাকায় গুলি হয়েছে, কয়েকজন ছাত্র শহীদ হয়েছে। তখনই তিনি প্রতিবাদে নেমে পড়েন। ছবি এঁকে সেই ছবি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিতে লাগলেন।
পুলিশ ব্যাপারটা টের পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনায় একমাস কারাবাস বরণ করতে হয় কিশোর মুস্তাফা মনোয়ারকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারতে অবস্থানকালীন বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব দেন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন।
ভিন্ন চিন্তা ও সৃজনকর্মে অজন্ম তিনি সাধনা করে চলেছেন। যা শিল্প-সৃজনে নতুন এক মাত্রা প্রতিষ্ঠা করেছে। তার হাত দিয়ে ক্যানভাসে যে তুলির আঁচড় পড়েছে, তাও হয়েছে প্রশংসিত। কলকাতা আর্ট কলেজের কৃতী এই ছাত্র সঙ্গীতেও সমান পারদর্শী।
মুস্তাফা মনোয়ার তার কর্মজীবন শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে। এরপর একে একে কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপ-মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা’র জেনারেল ম্যানেজার এবং এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি জনবিভাগ উন্নয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সেই ছাত্রজীবন থেকে পুরস্কার পাওয়ার যে শুরু তা জীবনভর চলে। ১৯৫৭ সালে কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস আয়োজিত নিখিল ভারত চারু ও কারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রাফিক্স শাখায় শ্রেষ্ঠ কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চারুকলা প্রদর্শনীতে তেলচিত্র ও জলরঙ শাখার শ্রেষ্ঠ কর্মের জন্য দুটি স্বর্ণপদক পান। চারুকলার গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক-এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৯০ সালে টিভি নাটকের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য টেনাশিনাস পদক লাভ করেন।
চিত্রশিল্প, নাট্য নির্দেশক এবং পাপেট নির্মাণে অবদানের জন্য শিশুকেন্দ্র থেকে ২০০২ সালে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯২ সালে চারুশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৯ সালে শিশু শিল্পকলা কেন্দ্র কিডস কালচারাল ইন্সটিটিউট, চট্টগ্রাম কর্তৃক কিডস সম্মাননা পদক-১৯৯৯-এ ভূষিত হন। ২০০২ সালে চারুকলা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী কর্তৃক ঋষিজ পদক-২০০২-এ ভূষিত হন। এছাড়া তিনি আরও বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।