‘কাশ্মির নিয়ে ভারতের টিভিতে বইছে ভুয়া খবরের বন্যা’

টাইমস রিপোর্ট
5 Min Read
পহেলগাম হামলার জেরে জম্মু-কাশ্মীরে সেনা টহল বাড়ান হয়েছে। ছবি: এপি/ইউএনবি
Highlights
  • 'কিন্তু গণমাধ্যম যখন খবর তৈরি করতে শুরু করে, খবর তখন আর খবর থাকে না, নাটকে পরিণত হয়। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলির একটি বড় অংশ এখন ঠিক সেই কাজটিই করছে। মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। তৈরি হচ্ছে বিভেদ।'

ভারতের কাশ্মিরের পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির ‘টেলিভিশনে বইছে ভুয়া খবরের বন্যা। অসত্য তথ্যের স্রোত বইছে সমাজ মাধ্যমে। যা দেখে মানুষ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।’

ওই সন্ত্রাসী হামলার ১০ দিন পর শুক্রবার ঘটনাস্থল থেকে জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষ সংবাদ ভাষ্যে জানাচ্ছেন এমন কথা।

তার মতে, মূল খবর থেকে সরে গিয়ে নাটকের এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমে। কাশ্মীরকে সামনে রেখে ক্রমাগত সেই কাজ করে চলেছে এক শ্রেণির মিডিয়া।

পাহেলগামে ২২ এপ্রিলের বন্দুক হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এর জেরে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান এখন যুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মহল। দৃশ্যত, এ নিয়ে দক্ষিণ-এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ছড়িয়েছে তীব্র উত্তেজনা।

আসিফ শেখের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছবি: দ্য হিন্দু থেকে সংগৃহীত।

এ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার রং-চড়ানো সংবাদের তীব্র সমালোচনা করে স্যমন্তক ঘোষ তার সংবাদ ভাষ্যে বলছেন, ‘বসে আছি আদিলের বাড়িতে। আদিল ঠোকার। পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলায় এই আদিল যুক্ত ছিল বলে সন্দেহ নিরাপত্তারক্ষীদের। শাস্তিস্বরূপ মাঝ রাতে আইইডি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ি। প্রতিবেশীর বাড়িতে বসে ওই ভাঙা বাড়ির দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে বসে আছেন আদিলের মা শাহজাদ। আর তাকে ঘিরে বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টার। একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে যাচ্ছে তার দিকে। তাদেরই মধ্যে একজন আচমকা শাহজাদকে প্রশ্ন করে বসলেন, ”বাড়িটা যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, আপনার কেমন লাগছিল?” প্রশ্ন শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকা চোখটা একবার কেবল কেঁপে উঠল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে শাহজাদ বললেন, আদিল যদি সত্যিই ওই ঘটনায় জড়িত থাকে, তাহলে এই শাস্তি তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করছেন।’

ডয়েচে ভেলের সাংবাদিকের আরো অভিযোগ, ‘এরপর আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন শাহজাদ, কিন্তু তার আগেই মুহূর্তের মধ্যে শাহজাদের ওই কথাটি নিয়ে শুরু হয়ে গেল টেলিভিশন লাইভ। ঠিক যেমন হচ্ছিল আরেক আদিলের বাড়িতে। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে পর্যটকদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন আদিল শাহ। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার শরীর। লিডার নদীর ধারে আদিলদের ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির বাইরে শামিয়ানা টাঙিয়ে বসে আছেন তার বাবা। বাইরে মিডিয়া চ্যানেলের ভিড়। একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করে যাচ্ছে সকলে, ”আদিলের মৃত্যুর পর ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে?” একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন আদিলের বাবা– ”দুখ ভি হ্যায়, ফকর ভি হ্যায়।” ফকর, অর্থাৎ গর্ব। আর ওই একটিই বাক্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোটা দিন ধরে তার মুখ দিয়ে বলিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। আদিলের বাবা যতবার নিজের জন্য সময় চাইছেন, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ততই ঘিরে ধরছে তাকে। জাপটে ধরছে।’

কাশ্মীরে পত্রিকার কালো প্রতিবাদ। ছবি: অনলাইন সংস্কৃরণ থেকে স্ক্রিনশট

সরেজমিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এই সাংবাদিক তীব্র সমালোচনা করেন নিজ পেশার সহকর্মীদের। তার ভাষ্য, ‘উরি সেক্টরে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখার (লাইন অব কন্ট্রোল) এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছানো গেছিল। ডয়চে ভেলে ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল আরো বেশ কিছু মিডিয়া। যার মধ্যে বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। উরি সেক্টরে প্রতিদিনই প্রায় গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু তা সীমান্ত পারাপার করছে না। এই ঘটনা সিস ফায়ার চুক্তি লঙ্ঘন করছে সন্দেহ নেই। তবে সীমান্তের মানুষ জানেন, কোন সংঘাত কেমন হয়। এখন যা ঘটছে, তা নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তিত নন। তাদের আশঙ্কা এমনটা যদি চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। শেলিং হলে তাদের বাড়ি ভেঙে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও তাদের আছে। কিন্তু এখনো সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, প্রকাশ্যে বলছেন তারা। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ওই এলাকার কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন সীমান্ত পার করে গুলি এসে পড়ছে পায়ের গোড়ায়। চূড়ান্ত নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রিপোর্টিং করা হচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে কার্যত ওই রিপোর্টিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।’

গণমাধ্যমের কাজ মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া– সাংবাদিকতার এই নৈতিকতা উল্লেখ করে সাংবাদিক স্যমন্তক বলেন, ‘কিন্তু গণমাধ্যম যখন খবর তৈরি করতে শুরু করে, খবর তখন আর খবর থাকে না, নাটকে পরিণত হয়। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলির একটি বড় অংশ এখন ঠিক সেই কাজটিই করছে। মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। তৈরি হচ্ছে বিভেদ।’

তার উপসংহার, ‘জনপ্রিয় কে না হতে চায়? কিন্তু জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যে কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, তা শুধু চিন্তার নয়, ভয়ের। আর এই ভয়ই ক্রমশ গ্রাস করছে ১৪০ কোটির একটি দেশকে। এ এক অদ্ভুত যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।’

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *