‘এক দফা শোনার জন্য সবাই মুখিয়ে ছিলেন’

টাইমস রিপোর্ট
7 Min Read
‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন’...জুলাই অভ্যুত্থানে লড়াইয়ের একদিন। ছবি: সাদিক আল আশফাক

‘ডিবি কার্যালয় থেকে বের হয়ে খবর পেলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ডিবি কার্যালয় থেকে প্রচারিত আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এই সিদ্ধান্তের জন্য সবাইকে সাধুবাদ জানালাম। জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা আদায়ের বিষয়ে “ছয় সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি” শিরোনামে একটা বিবৃতিও আমরা দিলাম,’ এভাবে উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণায় বলেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক,  বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক গ্রন্থে অভ্যুত্থানের দিনলিপি তুলে ধরেছেন সজিব ভূঁইয়া। গত মার্চে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিত বইয়ে ‘চূড়ান্ত লড়াই’ পর্বে তিনি তুলে ধরেন চূড়ান্ত বিজয়ের আগের দিনগুলোর  কথা।

জুলাই অভ্যুত্থানের মহানায়ক আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। ছবি: ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘ডিবি ছেড়ে দেওয়ার পর আমরা সবাই নিজেদের পরিবারের সঙ্গে চলে গেলাম। আমাকে নিয়ে গেলেন বড় মামা। আমাদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিবি গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। মূল গন্তব্যে না গিয়ে আমরা অন্য একটা জায়গায় নেমে পড়লাম, যাতে ডিবি আমাদের অবস্থান জানতে না পারে। এরপর আমি দনিয়ায় মামার বাসায় গেলাম। সেখানে কেউ আর আমাকে ছাড়তে চাইল না। তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, সবশেষে রাগারাগি করে রাতে আমি মামার বাসা থেকে বের হয়ে আসি।’

‘সেখান থেকে আমার গ্রামের বন্ধুস্থানীয় এক ভাইয়ের কাছে গেলাম। সে কাজ করত একটা সুপারশপে, থাকত মানিকনগরের এক বাসায়। আমি তার বাসায় গিয়ে উঠলাম। যোগাযোগ করলাম বাকেরের সঙ্গে। বাকের কাছেই ছিল। পরিস্থিতি বোঝার জন্য আবদুল কাদের, হান্নান মাসউদ আর রিফাত রশীদের সঙ্গে অনলাইনে একটা ছোট বৈঠক করলাম। তারা কী অবস্থায় আছে, কেমন আছে-সেই খোঁজখবরও নিলাম। বললাম, “আন্দোলনটা যেহেতু তোমরা চালিয়ে আসছ, তোমরাই চালিয়ে যাও। পরিস্থিতিটা আমরা আরেকটু বুঝে নিই।” নাহিদ ভাই নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন।’

‘২ আগস্ট কাদের, মাসউদ আর রিফাত কর্মসূচি দিল। সেদিন সব জায়গা থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে আসে। এদিনও খুলনা, সিলেট ও ঢাকার কয়েক জায়গায় পুলিশ গুলি চালায়। হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বামপন্থস্ত্রী ছাত্ররা সেদিন “দ্রোহযাত্রা” ডেকেছিল। বিস্মিয়াভাবে আরও নানা কর্মসূচি চলছিল। আমরা আন্দোলনের শক্তিটা বোঝার চেষ্টা করলাম। সেদিন অভিভূত হয়ে লক্ষ করলাম, বাংলাদেশের মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে হাসিনার পতনের দাবিতে এক হয়ে গেছে। উপলব্ধি করলাম, সময় ঘনিয়ে আসছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম, “শক্তি দাও।”

‘আমরা পরের দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করলাম, “সারা দেশে ছাত্র-নাগরিকের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে খুনের প্রতিবাদ ও ৯ দফা দাবিতে শনিবার (৩ আগস্ট) সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল এবং রোববার (৪ আগষ্ট) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন।”

আন্দোলনের বামপন্থীদের অবদানের কথা জানিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘২ আগস্ট মধ্যরাতেই ঘোষণা দেওয়া হলো, ৩ আগস্ট বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে আমরা থাকব। তখনো শেখ হাসিনার পতন এবং ফ্যাসিবাদের বিলোপের এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়নি।’

‘ডিবি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর সবকিছু বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছিল, এক দফার ঘোষণা দেওয়ার জন্য পরিস্থিতি প্রস্তুত হয়ে গেছে। ২ আগস্ট কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে এক দফার কথা বলেছিলেন। “দ্রোহযাত্রা” থেকেও সরকারকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। তবে তাদের সেই আহ্বান সর্বাত্মক সাড়া পায়নি। খুব সংহতভাবে এক দফার ঘোষণা শোনাও যায়নি।’

‘কাদের, রিফাত ও হান্নান মাসউদ বলছিল, এক দফা ঘোষণার সময় হয়ে গেছে। ৩ আগস্ট আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে এক দফা ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ২ আগস্ট রাতেই এক দফা ঘোষণার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রব উঠে গিয়েছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, এক দফার ঘোষণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নয়, রাজপথ থেকেই করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তখনো পর্যন্ত বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের কাছে এমন একটা বার্তা আসছিল যে সরকার পতনের দিকে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপি এখনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়নি, যদিও বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই আন্দোলনের মাঠে ছিল। তারা আন্দোলনের একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের ওপর তাদের অগাধ ভরসা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে এক দফার সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের কোনো বৈঠক করতে হয়নি। কোনো দল সিদ্ধান্ত না নিলেও বাংলাদেশের মানুষেরা আন্দোলনের মাঠে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল। একধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল। এক দফা যে হবে, সবাই যেন সেটা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। তবে এক দফাটা কী হবে, সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল।’

‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’…জুলাই অভ্যুত্থানে লড়াইয়ের একদিন। ছবি: সাদিক আল আশফাক

‘কাদের, মাসউদ ও রিফাত তাদের মতো করে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল। আমি আর বাকের ছিলাম একসঙ্গে। বাকিরাও আলাদা আলাদা জায়গায় ছিল। আমরা যারা ডিবি কার্যালয়ে বন্দী ছিলাম, তারা আগের ফোনগুল্যে আর ব্যবহার করিনি। ফোনে তারা কোনো ডিভাইস যুক্ত করে দিয়েছিল কি না, তা নিয়ে আমাদের আশঙ্কা ছিল। নিরাপত্তার জন্য নতুন ফোনে ভিপিএন ব্যবহার করে কথা বলছিলাম।’দ

‘মাহফুজ ভাই আর নাহিদ ভাই মিলে এক দফার ঘোষণা লিখলেন। আমি লিখি অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা। ৩ আগস্ট আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গেলাম। অনেক ভয় ছিল। তবে পুলিশ সেদিন নির্বিচার গুলি চালায়নি। শহীদ মিনারে কেন্দ্রীয় সমাবেশে ছাত্র-জনতার ঢল নামল। সে সময় ঢাকায় যাতায়াত করা আমাদের জন্য সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ছাত্রলীগ-যুবলীগ পাড়ায় পাড়ায় পাহারা বসিয়েছিল। আমাদের লুকিয়ে-চুরিয়ে শহীদ মিনারে আসতে হয়।’

আন্দোলনের শেষদিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনারে পৌঁছে দেখি, যত দূর চোখ যায়, তত দূর মানুষ আর মানুষ। এক দফা শোনার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে। আমাদের যখন দুই পর্বে তুলে নেওয়া হয়, এই মানুষেরাই তখন আন্দোলন চালিয়ে নিয়েছে। জনতার চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই, পরম কোনো বন্ধু নেই। নাহিদ ইসলাম শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং ফ্যাসিবাদ বিলোপের এক দফা ঘোষণা করলেন। পুরো শহীদ মিনার নাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে সমস্বরে কণ্ঠ মেলাল। আমি অসহযোগ আন্দোলন এবং তা বাস্তবায়নের রূপরেখা ঘোষণা করলাম। আমাদের এত দিনের পাঠচক্র বা আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বোঝাপড়া বা মতৈক্য তৈরি হয়েছিল যে শুধু শেখ হাসিনার পতন হলে চলবে না, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থারও বিলোপ ঘটাতে হবে। আমাদের এক দফা সেভাবেই লেখা হয়’… যোগ করেন তিনি।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *