উল্টে গেল পাশার দান!

জসীম আহমেদ
5 Min Read
‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক/টাইমস

এক বছর আগে আজকের এই দিনে, শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। একই সঙ্গে পতন হয়েছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলের। আর এই দলটিই প্রতিনিধিত্ব করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে। তবে ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডিক পতনের সূচনা বেশ আগেই। দলের ভেতরে গণতন্ত্র ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়াতেই দুর্নীতি আর লুটপাটের তরিকায় বোনা হয়েছিল পতনের বীজ।

পতনের এক বছরে দলটির নেতা-কর্মীরা বিদেশে আত্মগোপন করেছেন, তাদের সমর্থকরা দেশে নিগৃহীত হয়েছেন, আর দলের বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক শ্রেণির অনেকেই মূল্য দিচ্ছেন তাদের অতীত ভূমিকার, তারা একই সঙ্গে খুইয়েছেন সব আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি।

এই একবছরে আওয়ামী লীগ বা এর কোনো নেতা এমন কোনো বক্তব্যও দিতে পারেননি, যা কর্মী-সমর্থকদের অনুপ্রানিত করতে পারে। হতাশাগ্রস্ত কর্মী-সমর্থকদের আরো হতাশার অতলে ডুবিয়ে দিয়ে নেতারা বেছে নিয়েছেন প্রবাসের নিরাপদ জীবন। দৃশ্যতই প্রজ্ঞা ও রণকৌশলের অভাবে দলটি এখন বিলীনের পথে।

শুরুতে ট্র্যাজেডিক যে পতনের কথা বলা হয়েছিল, তার প্রকাশ ঘটেছিল ক্ষমতাসীন দাম্ভিক আওয়ামী লীগের দ্বারা বুদ্ধিজীবীদের অপমান হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সুবিধাভোগী দলীয় বুদ্ধিজীবীরা কেউ একটিও কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে পারেননি, যার মাধ্যমে জনগণ আওয়ামীলীগের প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারে। ক্ষমতায় থাকার সময় এসব দালাল বুদ্ধিজীবীরা এতোটাই চাটুকারিতা করেছেন যে, এদের কথার দু’পয়সা মূল্যও আর অবশিষ্ট নেই।

গণঅভ্যুত্থানের মামলার চার্জশিট
‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক/টাইমস

বলা ভাল, একটি রাজনৈতিক দলের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি না থাকলে, তাদের অস্তিত্বের ক্রমশ বিলীন অনিবার্য। এক সময় বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিতে এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নিজের বিশাল দলীয় শক্তিকে নিজেই শেষ করেছে। এই বিপর্যয়ের কারনে দলের প্রধান ক্রমেই নিজের কর্মীবাহিনী এবং জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ফলে একজন গণতান্ত্রিক নেত্রী থেকে শেখ হাসিনা রূপান্তরিত হন স্বৈরশাসকে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা, এমনকি তার মন্ত্রী পরিষদের সদস‍্যরা চাটুকারিতায় এতোটাই অভ্যস্ত ছিলেন যে, কোনো ন্যূনতম সমালোচনাও তারা সহ‍্য করতে পারতেন না। শুভাকাঙ্খীদের গঠনমূলক আলোচনাকেও তারা অবজ্ঞা করেছেন, যা দলটিকে রাজনৈতিকভাবে পরিণত করে দেউলিয়ায়।

২০১১ সালে, সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেন আবুল মকসুদ। তিনি সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তীব্র আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তখনই এই ঘটনা প্রমান করেছিল তার সরকারের দেউলিয়াত্বের পদযাত্রা।

শেখ হাসিনার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী আনু মুহাম্মদকে ‘টোকাই’ পর্যন্ত বলেছিলেন! তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, এ ধরনের শিষ্টাচার বহির্ভুত আক্রমণ দলীয় প্রধানের আশকারা ছাড়া কীভাবে সম্ভব? এই ধরনের কিছু কিছু ঘটনা দলের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা প্রকাশের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতাও তৈরি করে।

হাসিনা সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরাও বুদ্ধিজীবীদের অপমান করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। শিক্ষকদের অপদস্থ করা, সুশাসনের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা এবং প্রকাশকদের ওপর জঙ্গি হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পরেও সরকার ছিল নিশ্চুপ। ২০১৩ সালে লেখক অভিজিৎ রায় ও ২০১৫ সালে প্রকাশক দীপন হত্যাকাণ্ডের পর এর বিচারের কার্যকর পদক্ষেপও তারা নেয়নি, যা প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের মধ্যে তৈরি করেছিল গভীর হতাশা।

২০১৯ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ‍্যমে হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে নিজেদের পক্ষে লেখার জন‍্য কিছু ভৌতিক কলামিস্ট নিয়োগ দিয়ে হাস্যরসের জন্ম দেয়। এই ধরনের পদক্ষেপ পরোক্ষভাবে প্রমাণ দেয়, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি সম্পূর্ণরূপে ফুরিয়েছে আগেই। আর এসবই দেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবী সমাজকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’…অগ্নিগর্ভ জুলাই, গণঅভ্যুত্থানের কাল। ছবি: সাদিক আল আশফাক/টাইমস

একটি রাজনৈতিক দল যখন বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি এবং মূল্যবোধের প্রতি এইভাবে অবজ্ঞা দেখায়, তখন সেটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হয়ে ওঠে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

রাজনৈতিক শক্তির সাথে আদর্শ ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির সমন্বয় না থাকলে, কোনো দলই টিকে থাকতে পারে না, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে সর্বোচ্চ মূল্য চুকিয়ে এ কথাই প্রমাণ করল।

দলটির ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, সরকার কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দম্ভে টিকে থাকতে পারে না। রাজনৈতিক শক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির সম্মিলনে তাকে টিকে থাকতে হয়। ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা হরণ, গুম, খুন, দুর্নীতি ও লুটপাটে শাসক হিসেবে শেখ হাসিনা স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিলেন। একইভাবে তিনি দলের ভেতরও হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর স্বৈরাচার। মন্ত্রী পরিষদে তো বটেই, দলের ভেতরেও তার কথাই ছিল আইন। তাই হাসিনা সরকারের পতনের মাধ্যমে দলটিরও পতন হতে আর সময় লাগেনি।

৬০ দশকের গণঅন্দোলন ও ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম সরকার গঠন করলে সে সময়ের জনপ্রিয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে সাংবাদিক মহলে একটি কথা চালু ছিল, ‘আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন তারা একাই জেতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন হারে, তখন পুরো দেশ হেরে যায়।’

আর ৭৬ বছরের প্রাচীন দলটি এখন জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে এমনই দুরাবস্থায় পৌঁছেছে যে, ওই কথাটিকে সামান্য বদলে এখন বলতে হয়, ‘আওয়ামী লীগ যখন জেতে, তখন তারা একই জেতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন হারে, তখন পুরো দেশ জিতে যায়!’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *