ব্যাংককের সাংরি লা হোটেলে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই দুই নেতার বৈঠক প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়। সেখানে বড় ধরণের আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও দুই দেশের কূটনৈতিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কয়েক মাস ধরে নানা ইস্যুতে দিল্লি-ঢাকার সম্পর্কের পারদ ওঠানামা করছে। এ অবস্থায় দুই নেতার প্রথম বৈঠকে এসেছে অনেক অমিমাংসিত ইস্যু, সংকট সমাধানে স্পষ্ট বার্তা না পেলেও বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়।
বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেন আলাপচারিতার সারাংশ।
ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক ও জনকেন্দ্রিক সম্পর্কের ব্যাপারে ভারত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি বাংলাদেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, অর্ন্তভূক্তি এবং গণতন্ত্রের জন্য ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছি। অবৈধ সীমান্ত ক্রসিং প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য আমাদের গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।’
এদিকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আলোচনার কিছু বিষয় প্রকাশ করেছে ব্রিফিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বৈঠকের পর দিল্লির বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রিও উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে আলোচনার অনেক বিষয়। দ্বিপাক্ষিক এ বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশপাশি পুরনো কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন তার বক্তব্যে।
বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যকার গভীর বন্ধুত্ব পরস্পর সম্পর্কের ইতিহাস, ভৌগোলিক নৈকট্য ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ে ভারতের সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’
‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ গভীরভাবে মূল্যায়ন করে। আমাদের উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে সম্পর্ককে সঠিক পথে নিয়ে যেতে আমরা আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। গত আট মাস ধরে দুই দেশের মধ্যে অসংখ্য দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে।’
তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনে আলোচনার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান ও তাকে হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন মাধ্যমে উসকানিমূলক মন্তব্য করে যাচ্ছেন এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন, যা ভারতের আতিথেয়তার অপব্যবহার বলে মনে হচ্ছে।’
‘তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা ও উসকানিমূলক অভিযোগ করে আসছেন। আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ করছি, তিনি যতদিন আপনার দেশে থাকবেন ততদিন তাকে এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিন।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘ওএইচসিএইচআর রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছে যে বিক্ষোভ-সম্পর্কিত ১ হাজার ৪০০ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু ছিল। বিক্ষোভ চলাকালে হত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ডের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক ভিত্তিও প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং নির্দিষ্টভাবে তাদের চক্রের নেতাদের গ্রেফতার করা, তাদের হত্যা করা এবং তাদের লাশ লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
নয়াদিল্লি সবসময়ই ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুই প্রতিবেশী দেশের ইতিহাস ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এবং এটি বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই। ভারত সব সময় প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সমর্থন করবে।’
ভারত বাংলাদেশের বিশেষ কোনও দলকে সমর্থন করে না উল্লেখ করে মোদি বলেন, ‘ভারত শুধু দেশের সঙ্গে আছে, কোনও ব্যক্তি বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নয়।’
সীমান্ত হত্যার বিষয়ে দুই নেতা একযোগে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে বৈঠকে মোদি উদ্বেগ প্রকাশ করলে প্রফেসর ইউনুস বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবেদনগুলো ব্যাপকভাবে ফুলে ফেঁপে করা হয়েছে এবং এর বেশিরভাগই ভুয়া খবর।’
তিনি দেশে ধর্মীয় ও লিঙ্গ সহিংসতার প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তার সরকার এ ধরনের ঘটনা রোধে গুরুতর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে বৈঠকে জানান।
উভয় নেতা একে অপরের সুস্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত মঙ্গল কামনা করে তাদের ফলপ্রসূ ও সৎ সংলাপ শেষ করেন এবং উভয় দেশের জনগণের অব্যাহত শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন।