বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত একটি বৈঠকের দিকে এখন সকলের নজর। আগামী ১৩ জুন লন্ডনে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকটি নতুন করে রাজনৈতিক গুঞ্জন এবং আশাবাদের সঞ্চার করেছে।
এই বৈঠককে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধানের সম্ভাব্য একটি মোড় পরিবর্তনকারী মুহূর্ত হিসেবে দেখছে বিএনপি।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লন্ডন বৈঠককে ‘সময়োপযোগী ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই বৈঠক চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে পথ খুলে দিতে পারে।
তারেক-ইউনূস বৈঠককে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, ’জুলাই মাসের গণআন্দোলনে তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, যার ফলেই বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই দুই পক্ষের মধ্যে যদি কার্যকর আলোচনা হয়, তাহলে জটিল সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব হতে পারে।’
বৈঠকের সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনো নির্বাচনের সময় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর অবিশ্বাস বিরাজ করছে।
ড. ইউনূস আগে বলেছিলেন, নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। তবে ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সময়সূচি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
বিএনপি এই সময়সূচিকে অবাস্তব বলেছে। দলটির মতে, রমজান মাসে নির্বাচনী প্রচার চালানো অসম্ভব হবে। বর্ষাকালও একটি বড় সমস্যা।
ইউনূস-তারেক বৈঠক প্রসঙ্গে বলতে গিয়েও ফখরুল বলেছেন, ‘এপ্রিল সময়টা নির্বাচনের জন্য আদর্শ নয়। রোজার মধ্যে প্রচারণা কঠিন হবে, গরম থাকবে প্রবল। ইফতার আয়োজনে প্রচারণার টাকা ফুরিয়ে যেতে পারে, আর জনসভাগুলো রাতের দিকে নিয়ে যেতে হবে।’
নির্বাচনের সময় নিয়ে মতপার্থক্য থাকার পরও ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠককে সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিএনপি অভ্যন্তরীণভাবে এবং প্রকাশ্যেই বৈঠকের গুরুত্ব তুলে ধরেছে। তারা বলছে, এটি চলমান সংকটের সমাধানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
সূত্র মতে, আলোচনায় চারটি মূল বিষয় উঠে আসতে পারে: নির্বাচনের সময়সূচি পুনর্বিবেচনা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা রক্ষা।
তবে ফখরুল জানান, বৈঠকের কোনো নির্ধারিত এজেন্ডা নেই। ‘আলোচনা হবে উন্মুক্ত ও বিস্তৃত,’ বলেন তিনি।
জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন শাসন কাঠামো পুনর্গঠনের সম্ভাবনাও আলোচনায় আসতে পারে।
এই বৈঠক আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নজর কেড়েছে।
সম্প্রতি ড. ইউনূস একাধিক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। একইসাথে, তারেক রহমান বিএনপির কূটনৈতিক যোগাযোগ বিস্তৃত করছেন।
বিএনপি মহাসচিবও বলেছেন, এই বৈঠক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু বিশ্লেষক বৈঠকটিকে ‘ব্যাকচ্যানেল আলোচনা’ বা একটি অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সমঝোতার সূচনা হিসেবে দেখছেন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, যদি বৈঠকটি শুধুই সৌজন্য সাক্ষাতে সীমাবদ্ধ না থেকে গঠনমূলক আলোচনায় রূপ নেয়, তাহলে তা একটি বড় রাজনৈতিক অগ্রগতির পথ খুলে দিতে পারে– বিশেষ করে যদি নির্বাচনের সময়, কাঠামো এবং অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। তাৎক্ষণিক ফল না এলেও এটি অচলাবস্থা ভাঙার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
তবে, সবকিছু নির্ভর করবে আলোচনা কতটা বাস্তবমুখী হয় এবং অর্জিত সমঝোতা কার্যকর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা থাকে তার ওপর।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: এই বৈঠক কি সমাধানের পথ তৈরি করবে? তারেক রহমান ও ড. ইউনূস কি একটি নতুন জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করতে পারবেন?
‘জাতীয় ঐক্য রক্ষা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেউ কেউ বলে বিএনপি নাকি সংস্কারের বিরোধী, কিন্তু আমাদের ‘ভিশন ২০৩০’ ছিল প্রথম বড় সংস্কার প্রস্তাব। বিএনপি সবসময় সংস্কারের পক্ষে থেকেছে,” বলেন মির্জা ফখরুল।
তবে তার সতর্কবার্তাও আছে। তিনি বলেছেন, ‘সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হবে এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’