‘২০২৪ সালের ৫ জুন দুপুর। চানখাঁরপুলে ঢাকা মেডিক্যালের পাশের গ্যারেজে আমার স্কুটি ঠিক করাচ্ছি। সেখানে থাকা অবস্থায়ই ফেসবুকে দেখতে পেলাম, একটা রিটের রায়ে হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি আবার পুনর্বহাল করেছে। ২০১৮ সাল থেকে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের বেশ কিছু অর্জন ছিল। এই খবরটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, আমাদের অধিকারের লড়াইগুলো মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এ রকম মনে হওয়ার কিছু কারণ ছিল,’-–স্মৃতিচারণায় বলছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক, বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক গ্রন্থে অভ্যুত্থানের দিনলিপি তুলে ধরেছেন সজিব ভূঁইয়া। অকপটে জানিয়েছেন রক্তস্নাত সেই উত্তাল দিনগুলোর অনেক অজানা কথা। গত মার্চে বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
এর প্রথম অধ্যায় ‘আন্দোলনের ডাক’ পর্বে তিনি বলছেন, ‘আবরার ফাহাদের শাহাদাতের পরে ছাত্রদের সংগ্রামের কারণে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। বুয়েটে অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির অধিকারই ছিল না বলে প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের রাজনীতিই নিষিদ্ধ হয়। কিছুদিন আগে সেটাও হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আরও শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং ইতিমধ্যে দলটির যে ক্ষতিগুলো হয়েছিল, সেগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।’
‘এটা ছিল আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর অনুভূতি। কারণ, আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের অর্জনগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তখনই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল ছিল ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন। আবরার ফাহাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি, অর্থাৎ ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। এটাও শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ের ফসল। এসব অর্জন একের পর এক মুছে দেওয়া হচ্ছিল। কোনো বিরোধী দল ছাড়াই ৭ জানুয়ারির পাতানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গিয়েছিলেন।’
আসিফ মাহমুদ ছাত্রদের সংগঠিত হওয়া নেপথ্য পটভূমি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, আমরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোকেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আমরা বারবার পরাজিত হতে দেখছিলাম। “ঈদের পরে আন্দোলন” একটা ব্যাঙ্গ (ট্রলে) পরিণত হয়েছিল। সব মিলিয়ে ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের যে গণতান্ত্রিক লড়াই, তাতে পরাজিত হতে হতে একদম দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল।’

‘৫ জুন কোটা পুনর্বহালের রায় দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ফেসবুকে এক পোস্টে লিখি, “আমাদের সব অর্জন একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ আরও বড় দৈত্যরূপে হাজির হচ্ছে।”
‘কিছুক্ষণের মধ্যে আবদুল হান্নান মাসউদ (বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক, জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা) আমাকে ফোন করে বলল, “ভাই, এটা নিয়ে কি কিছু করা যায়?” তখন বিকেল। গ্যারেজ থেকে স্কুটি ঠিক করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গেলাম। সেখানে নাহিদ ভাই (নাহিদ ইসলাম, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা), রিফাত রশীদ (বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য) এবং হাসিব আল ইসলাম (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক) ছিলেন। মূলত গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ প্রাথমিকভাবে সেখানে একত্র হই। আমরা আলাপ করছিলাম, কীভাবে হাইকোর্টের দেওয়া কোটা পুনর্বহালের রায়ের প্রতিবাদ করা যায়।’
‘এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ফেসবুক গ্রুপগুলোতে কোটা পুনর্বহালের বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে কর্মসূচি নিয়ে সেখানে কেউ আলাপ করছিল না। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? এমন একটা পরিস্থিতি। আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, তাৎক্ষণিক একটা প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার। সাধারণত যখন কোনো কর্মসূচিতে জমায়েত কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন আমরা সন্ধ্যায় সেই কর্মসূচি দিই। এতে ২০-২৫ জন মানুষ স্লোগান দিলেও জনবলের ঘাটতিটুকু চোখে পড়ে না। মনে হয়, বড় কর্মসূচিই হচ্ছে।’
আসিফ মাহমুদ আরো বলেন, ‘আলোচনা শেষে লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়েই আমরা সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় একটা কর্মসূচি ঘোষণা করি। নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগুলোসহ অনলাইনে কর্মসূচিটির প্রচারণা শুরু হয়। স্কুটিতে করে আমি নীলক্ষেতে চলে যাই। সেখান থেকে কর্মসূচি সফল জন্য লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুনের কাগজ, আর্ট পেপার ও মার্কার সে আসি। লাইব্রেরির সামনে যখন ফেস্টুন আর প্ল্যাকার্ড প্রস্তুত করি।’
‘আমাদের মধ্য থেকে তিন-চারজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ভেতরে পাঠানো হয়। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমাদের একটা অভিজ্ঞতা ছিল। বিসিএস বা সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের বেশির ভাগই লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে বলে সেখানে এ ধরনের কর্মসূচিতে জমায়েত বেশি হয়।’
‘লাইব্রেরিতে চাকরিপ্রত্যাশী এবং অন্য শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। খুব যে বেশি সাড়া পাব, সেই প্রত্যাশা আমাদের ছিল না। কিন্তু ৫ জুন ভালোই সাড়া পাওয়া গেল। পাঁচ-ছয় শ শিক্ষার্থী আন্দোলনে নেমে এলেন। সেদিন আমরা ক্যাম্পাসে একটা মিছিল করে লাইব্রেরির সামনে এসে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ করি। আন্দোলনটা আমাদের দীর্ঘ সময় ধরে করতে হতে পারে বলে সেখানেই আমরা উন্মুক্ত স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করি। সে আহ্বানে ২৫-৩০ জন সাড়া দেন। পরে তাদের নিয়ে সমাজবিজ্ঞান চত্বরে দাঁড়িয়ে আমরা আলোচনা করি, কীভাবে সামনের দিনের কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।’

‘এই সময়টাতে আমাদের কোর গ্রুপের সঙ্গে আরও কয়েকজন এসে যুক্ত হন, যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন এবং নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী। সায়েন্স লাইব্রেরিকে কীভাবে এই আন্দোলনে যুক্ত করা যায়, এ বিষয়টি নিয়েও সেদিন আলোচনা হয়। হলের শিক্ষার্থীদের এর সঙ্গে যুক্ত করা এবং পরদিন থেকে আন্দোলন পরিচালনার কৌশল ইত্যাদি বিষয়েও সেখানে কথা হয়।’
লড়াই-সংগ্রামের কৌশল সম্পর্কে আসিফ মাহমুদ আরো বলেন, ‘প্রাথমিক আলোচনা শেষে অন্যরা চলে যাওয়ার পর নাহিদ ইসলামসহ আমরা আলোচনা করি এই আন্দোলনের রাজনৈতিক চেহারাটা কী রকম হতে পারে। আমরা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ও বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ছাত্রশক্তি নতুন ও ছোট ছাত্রসংগঠন হওয়ায় অনেক ঝুঁকির বিষয় ছিল। নির্দিষ্ট মানুষজন হওয়ায় আমাদের আঘাত করা বা লক্ষ্যবস্তু বানানোটা খুব সহজ।’
‘আমাদের ধারণা ছিল, আমাদের টার্গেট করে দমিয়ে দিতে পারলে বাকিদেরও থামিয়ে দেওয়া ছাত্রলীগের জন্য সহজ হবে। ক্যাম্পাসে তখন যে পরিস্থিতি, তাতে এই বিষয়টা সব সময় মাথায় থাকত। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমরা আলোচনা করি, কৌশলে কীভাবে আন্দোলন এগোনো যায়, কীভাবে প্রয়োজনে পরিচিত মুখগুলোকে পেছনে রেখে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিতদের সামনে রাখা যায়, যাতে আমরা টার্গেট না হই এবং আন্দোলনের নেতারা কোনো ট্যাগিং কালচারের শিকার না হন। সব আন্দোলনকে তখন নানা রকমের ট্যাগ দেওয়া হতো-শিবির, মৌলবাদী, জঙ্গি ইত্যাদি। ছাত্রশক্তি বলে ট্যাগ দিয়ে যাতে আন্দোলনের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, কোটা পুনর্বহালের রায় যাতে আমরা বাতিল করতে পারি, সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য।’
‘প্রথম দিকে দাবি ছিল, ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করা। তবে ২০১৮ সালে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটা ঠিকই বহাল ছিল। আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়, আসলেই বৈষম্য নিরসন করতে হলে সব শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে একই দাবি হওয়া উচিত। আন্দোলনে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। চাকরির খাত খুবই অপ্রতুল হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সাত কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির প্রত্যাশী থাকে। সেই প্রত্যাশা থেকে সবাইকে যুক্ত করা এবং প্রকৃতপক্ষেই বৈষম্য নিরসন করতে সব শ্রেণির কোটা সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে আন্দোলনে রূপ দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি নিয়ে তখন ফেসবুকেও একধরনের বিভাজন দেখা যায়। অধিকাংশেরই মতামত, কোটা বৈষম্যের বিষয়টি সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।’
‘আমরা জানতাম, ৫ জুনের পর বেশি দিন ক্যাম্পাস খোলা থাকবে না। কারণ, সামনে ঈদুল আজহা। তাই ঈদের পর আবার আন্দোলন শুরু করতে যা যা করা প্রয়োজন, তা করতে হবে। তখনই কোনো কমিটি না করে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলনটা এগিয়ে নিতে চেয়েছি। ক্যাম্পাসের বাইরেও অনলাইনে বৃহত্তর জনমত গঠনের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছিল। ৬ জুন আমরা একটা কর্মসূচির ডাক দিই। সে সময় পর্যন্ত দাবি ছিল, কোটা পুনর্বহাল করা চলবে না। যেটা বাতিল ছিল, তা বাতিলই থাকতে হবে।’
‘৫ জুন হাসিব ও রিফাত ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ খোলে। ক্যাম্পাসে বহুদিনের অ্যাক্টিভিজম ও আন্দোলনের ফলে পরের সারির নেতৃত্বেরও অভিজ্ঞতা ছিল কীভাবে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়। তা ছাড়া তখন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’সহ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গ্রুপগুলোতে ছাত্রলীগের ওয়াচডগ হিসেবে থাকার প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। পোস্ট অনুমোদন হওয়া নিয়েও ছিল জটিলতা। এসব কারণে পরের সারির কর্মীরা নতুন গ্রুপ খোলার প্রয়োজন অনুভব করে। তারা ৫ জুনের কর্মসূচির আগেই একটা গ্রুপ খুলে ফেলে। সেদিন রাত থেকে ওই গ্রুপে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে,’ যোগ করেন আসিফ মাহমুদ ।