আব্দুল আলীম: রঙিলা নায়ের মাঝি

আহমেদ জামান শিমুল
5 Min Read
আব্দুল আলীম। ইলাসস্ট্রেশন: সজীব/টাইমস

বাংলা লোক গানের সম্রাট বলা হয় আব্দুল আলীমকে। এ মরমী গায়ক ভাটিয়ালি, আধ্যাত্মিক, মরমি ও মুর্শিদি—লোকগানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি। ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মারা যান আবদুল আলীম, আজ তার প্রয়াণ দিবস।

মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যাওয়া এ কিংবদন্তি রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র মিলিয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন ৫ শতাধিক গানে। এর মধ্যে তার পরিবারের কাছে রয়েছে ৩০০ এর মত গান। ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই’, ‘পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’র মত কালোত্তীর্ণ গানগুলোর কোনটিরই মূল রেকর্ড পরিবারের কাছে নেই।

শিল্পীর সন্তান নূরজাহান আলীম ও জহির আলীম টাইমস অব বাংলাদেশের কাছে দাবি জানালেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ শিল্পীর গানগুলো যেন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়।

‘শুধু প্রকাশিত গান নয়, বাবার অপ্রকাশিত গানের সংখ্যাও শতাধিক। তিনি তখন বহু স্টুডিও গিয়ে গিয়ে রেকর্ড করতেন। এসব গান হয় কোন কারণে তখন প্রকাশ হয়নি। সেগুলো যদি সংগ্রহ করে প্রকাশ করা যায়, নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে নতুন করে পরিচয় করানো যাবে’,–বলেন তার নূরজাহান আলীম।

স্বাধীনতার পূর্বে বেতারে অনেক গান করেছেন আব্দুল আলীম। ষাটের দশকে রেডিও পাকিস্তানে ‘মিতালী’ নামে একটি অনুষ্ঠান গত। সেখানে তার গাওয়া বাংলা, উর্দু গানগুলো প্রচার হত। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এ মহান শিল্পীর অসংখ্য গান রয়ে গেছে।

নূরজাহান আলীম জানান, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ রেডিওতে আব্দুল আলীম দেড়শয়ের মত গান গেয়েছিলেন। যার বেশিরভাগই উর্দুতে ছিল। বেশকয়েকবার সরকারের মাধ্যমে আবেদন করে এক বছরের প্রচেষ্টায় ১২টি গানের বাইরে আর কিছু পাননি।

জহির আলীম বলেন, “এ ব্যাপারটি নিয়ে লন্ডনের একটি প্রতিষ্ঠান ‘আব্দুল আলীম ফাউন্ডেশন’ কাজ করছে। তাদেরকে রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর তারা ‘মিতালী’ অনুষ্ঠানটি আবার প্রচার শুরু করেছে। সেখানে তারা বাবার গাওয়া বাংলা অনেক গানই নাকি প্রচার করছে। একই সঙ্গে তারা তার পুরানগুলো আমাদেরকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বলেও জানিয়েছে।”

যদিও বলা হয় আব্দুল আলীম বেশি মিশেছেন ভাটিয়ালী গানে, তারপরও তিনি কণ্ঠে তুলেছেন রবীন্দ্র, নজরুল, বাউল, মরমী, মারফতিসহ সকল ধরণের গান। ‘সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি’, ‘নাইয়া রে, নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘দোল দোল দোলনি’, ‘দুখিনীর পরানের বন্ধুরে’, ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’– এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী তিনি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৯৭৬ সালে যৌথভাবে এবং ২০২২ সালে এককভাবে শিল্পীর নামে স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করা হয়েছিল। এছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পরিবারের। তবে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্বল্পদৈর্ঘ্য ক্যাটাগরিতে ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছেন নূরজাহান আলীম। এটি নির্মাণ করছেন মীর শামছুল আলম বাবু।

‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ নামটি পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের লেখা গানের সংকলন। সেখান থেকে প্রামাণ্যচিত্রটির নাম নেওয়া। তবে এর পিছনে আলাদা আরেকটি ব্যাখাও দিয়েছেন নূরজাহান আলীম, ‘তিনি তো জীবনে অনেকরকম গান গেয়ছেন। তার জীবনটা অনেক রঙিন, অনেক অর্জনে ভরা। সে জায়গা থেকেই নামটি নিয়েছি আমরা।’

স্বল্পদৈর্ঘ্যটির জন্য সরকারের তরফ থেকে ১৬ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। যদিও নিয়মের কারণে পুরো টাকাটা এখনও পাননি তারা। নির্মাতা শামছুল আলম বাবু বলেন, “আমরা এতে শিল্পীর পুরো জীবন ও কর্ম তুলে আনার চেষ্টা করেছি। ১৯৭৩ সালে রেডিওতে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছিল। পুরো সাক্ষাৎকারটি আমরা প্রামাণ্যচিত্রে ব্যবহার করেছি। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এ প্লেব্যাক করেছিলেন। নেগেটিভ নষ্ট হয়ে যাওয়া বা অন্য কোনো কারণে গানটি আর ছবিতে ব্যবহৃত হয়নি। সে অপ্রকাশিত ‘আমি ভিন গ্রামের নাইয়া’ গানটিও আমরা এখানে ব্যবহার করেছি।”

তিনি জানান, প্রামাণ্যচিত্রে তার সঙ্গে কাজ করা নীনা হামদি, শওকত হায়দার খান, মুস্তাফা মনোয়ার, শিশুশিল্পী আলেয়ার শারাফী, আব্দুল হামিদ, সমর দাশ, সুজয় শ্যামসহ অনেকে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। এতে তার বিভিন্ন বিদেশ সফরের দৃশ্য, টেলিভিশনে গান গাওয়ার দৃশ্য, পুরস্কার নেওয়ার দৃশ্য ও তার গাওয়া তিনটি গান ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতের মুর্শীদাবাদে গিয়ে নেওয়া তার পরিবার-পরিজন ও ভাতিজার সাক্ষাৎকারও এতে রাখা হয়েছে।

‘সরকারী নিয়মে ৩০ মিনিটের বেশি আমরা স্বল্পদৈর্ঘ্যটির দৈর্ঘ্য রাখতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত হয়তো দৈর্ঘ্য ৩৭ মিনিট হয়ে যাবে। আসলে এত স্বল্প সময়ে এত বড় শিল্পীকে তুলে আনা কঠিন। তবুও আমরা তা চেষ্টা করছি’,—বলেন নূরজাহান আলীম।

শিল্পীর জন্মদিন ২৭ জুলাই। এ উপলক্ষে ২৫ শে জুলাই শিল্পকলা একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই মৃত্যুবার্ষিকীতে ওইভাবে আয়োজন করছেন না বলে জানালেন জহির আলীম। তবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) একটি অনুষ্ঠান প্রচার হবে বলে জানালেন তিনি। এছাড়া নূরজাহান আলীম জানান, পারিবারিকভাবে তাকে স্মরণ করে দোয়া-মাহফিল থাকছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *