জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা না পেয়ে অনুমানের ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলের শুরুতে নির্বাচন হতে পারে- এমন সম্ভাব্য সময় ধরে কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘তারিখ নিয়ে আমার পক্ষে বলা খুব কঠিন, কারণ আমি নিজেই জানি না সুনির্দিষ্ট তারিখ কবে।’
তিনি বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে শুধু শোনা গেছে যে রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে, যার মানে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই হতে পারে। আমরা কেবল অনুমান করছি, এখনো কোনো সরকারি নির্দেশনা আসেনি।’
তারিখের অনিশ্চয়তার মধ্যেও ইসির প্রস্তুতি চলমান জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছি। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ভাষণে বলেছিলেন, নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনে হতে পারে।’

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। তখন যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়।
এ বিষয়কে ইঙ্গিত করে সিইসি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা পেয়েছি। রমজান যেহেতু ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে শুরু হবে, তাই এখন ইসি ফেব্রুয়ারির শুরুতেই ভোটের প্রস্তুতিতে মনোযোগী, যদি ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না আসে। রমজান মাসের আগে অথবা এপ্রিলে ভোটের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের মাঝে পেয়েছি।’
সিইসি স্পষ্ট করে বলেন, ‘নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেটি ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ, কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়।’
সাক্ষাতে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলেও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি বলে জানান সিইসি।
তিনি বলেন, ‘ওটা জিজ্ঞেস করা ঠিক হতো না। রাজনৈতিক দলগুলো কেউ আগেভাগে নির্বাচন চায়, কেউ দেরিতে। আমি তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনি।’
ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)-এর পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নিয়ে সিইসি নাসির বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা নিরপেক্ষ। আমি যখন শপথ নিই, তখন সুপ্রিম কোর্টের বারান্দা থেকে এ প্রতিশ্রুতি দিই। রমজানের প্রথম দিনে ভোটার দিবস উপলক্ষে ইসির সব কর্মীকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার অঙ্গীকার করানো হয়।’
বিএনপি বা জামায়াতের প্রতি সহানুভূতির অভিযোগ সম্পর্কে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি বিএনপির সদস্য বা নেতা নই। এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। মানুষ বলতে পারে, কিন্তু আমাদের কাজ দেখে তারা বুঝে যাবে আমরা কতটা নিরপেক্ষ।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে গেজেট জারি নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘এটি স্থানীয় সরকার আইনের অধীন নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায় অনুসারে হয়েছে। আমরা আমাদেরই গঠিত আদালতের রায়ে পক্ষপাতিত্ব করতে পারি না।’
‘এ বিষয়ে সরকারের যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল, তা ইতোমধ্যে দূর হয়েছে। তারা এখন বুঝতে পেরেছে- এটি আইন অনুযায়ী ছিল এবং আমাদের ব্যাখায় বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হলে নিবন্ধন রাখার যৌক্তিকতা নেই। সে কারণে আমরা তা স্থগিত করেছি।’
এতে নির্বাচন কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক থাকবে- বিবিসির এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের উদ্বেগ ভোটারের অংশগ্রহণ নিয়ে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শব্দের সংজ্ঞা ব্যক্তি অনুযায়ী ভিন্ন হয়।’
‘আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ভোটার হিসেবে অংশ নেবেন, প্রার্থী হিসেবে না হলেও।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে সিইসি কোনো মন্তব্য করতে চাননি, কারণ বিষয়টি বিচারাধীন। তবে এক সাবেক সিইসিকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করার ঘটনায় তিনি নিন্দা জানান।
সিইসি নাসির বলেন, ‘এমন ঘটনার কেউ সমর্থন করে না। দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উঠলেও সিইসি বলেছেন, ‘এটি এখন বাস্তবসম্মত নয়। স্থানীয় নির্বাচন সাধারণত সহিংসতা-প্রবণ এবং একাধিক ধাপে হয়, যার জন্য ১০ থেকে ১২ মাস সময় লাগে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সেটা সম্ভব নয়, এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টাও এখনো স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে কিছু বলেননি।’
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও প্রতীক প্রসঙ্গে তিনি জানান, প্রায় ১৫০টি রাজনৈতিক দলের আবেদন যাচাই করছে নির্বাচন কমিশন। মাঠপর্যায়ের ৫,৭০০ ইসি কর্মীর সহায়তায় সময়মতো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। বিতর্কিত শাপলা প্রতীক কোনো দলকে দেওয়া হবে না, আইনগত ও প্রক্রিয়াগত কারণে। এনসিপি ও নাগরিক ঐক্য উভয়েই এটি চেয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীর ‘দাড়িপাল্লা’ প্রতীক প্রসঙ্গে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘দলটির নিবন্ধন পুনর্বহাল হওয়ায় প্রতীকটিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে এসেছে। এটি সুপ্রিম কোর্টের আদেশের ভিত্তিতে হয়েছে।’
নিজের কর্মজীবনের শেষ চ্যালেঞ্জ হিসেবে সিইসি পদ গ্রহণ করেছেন বলে জানান নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘এই সংকটময় মুহূর্তে আমি দেশকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। হাসিমুখে এসেছি, হাসিমুখে বিদায় নিতে চাই।’
নির্বাচন কমিশনের সাফল্যের জন্য সব প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।