স্যারকে নিয়ে তো বহুৎ স্মৃতি- সে প্রথম দেখার স্মৃতি মনে পড়ে। ১৯৭৩ সাল। তখন আমি ৮ম শ্রেণিতে পড়ি। মোহাম্মদপুর গর্ভমেন্ট স্কুলের হোস্টেল কোয়াটারে থাকি। আব্বা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক।
তখন নন্দিত নরকে প্রকাশিত হয়েছে, চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। উপন্যাসটির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছিল, ‘দিতে পার একশ’ ফানুস এনে/ আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।’ মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।
আমি চিন্তা করলাম, ওনার সঙ্গে দেখা করবো। খোঁজ নিলাম উনি কোথায় থাকে। হঠাৎ এক বন্ধু বললো, হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু আমাদের সাথে পড়ে আহসান হাবীব তার ভাই। ওকে আমরা শাহীন ডাকতাম। ওরে ধরলাম, কেন বলেনি। শাহীন বললো, ‘আরে বলার কী আছে?’ ওর কাছে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। সে রাজি হলো। জানালো, হুমায়ুন রোডের পাশে বাবর রোডেই বাসা।
একদিন সকাল বেলা শাহীনের সঙ্গে গেলাম। উনি ড্রয়িং রুমে বসে বই পড়ছিলেন। ওনার সঙ্গে সালাম বিনিময় হলো। নাম, পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। আরও জিজ্ঞেস করলেন, ‘পড়াশোনা ঠিকঠাক করো?’ আমি বললাম, ‘জি করি। আমি একজন শিক্ষকের ছেলে। আমাকে জোর করে হলেও পড়তে হয়।’ উনি মুচকি হেসে, উপরে যেতে বললেন।
শহীদ পরিবার হওয়ায় দোতলা বাসাটি পেয়েছিলেন তারা। শাহীনের রুম ছিল উপরে চিলেকোঠায়। সে তখন ছবি আঁকছিল। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ফিরে আসলাম। এটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখার স্মৃতি।
আমি ১৯৮০ সাল থেকে ঢাকা থিয়েটারে অভিনয় করি। তখন ঢাকা থিয়েটার থেকে কাউকে সহজে টিভি নাটকে অভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হত না। আমি ১০ বছর পর অনুমতি পেলাম। বিটিভিতে অডিশন দিলাম। প্রথমবার ফেল করলাম, পরের বার পাশ করলাম এবং টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করলাম।
একদিন বিটিভির বিখ্যাত প্রযোজক রিয়াজ উদ্দিন বাদশা ডাকলেন। আমি তখন মঞ্চে উরাধুরা অভিনয় করি। চক্র, কেরামত মণ্ডল, কিত্তনখোলা, বনপাংশুল, প্রাচ্য, মুনতাসির ফ্যান্টাসি— এরকম বহু বিখ্যাত নাটকে অভিনয় করেছি। বাদশা ভাই হুমায়ূন ভাইকে বললেন, ওর নাম ফারুক। মঞ্চে ভালো অভিনয় করে। আমি ১৯৭৩ সালের পরিচিত হওয়ার ঘটনা আর বললাম না।
হুমায়ূন ভাইয়ের আমাকে পছন্দ হলো। তিনি পরের দিন আবার আসতে বললেন। রিহার্সেল করতে বললেন। ‘অচিন বৃক্ষ’ ছিল নাটকের নাম। এরপর তো ‘আজ রবিবার’ করলাম– এভাবে শুরু।
২০-২২ বছর ছিলাম ওনার সঙ্গে। কত স্মৃতি! বলে কি শেষ করা যাবে। মনে পড়ে রমজান মাসে নুহাশ পল্লীতে খোলা মাঠে ৪০ জনকে তিনি ইফতার করেছিলেন। তিনি প্রত্যেককে নিজ হাতে খাইয়েছিলেন। এতে উনি যে আত্মতৃপ্তি পেতেন, আনন্দ পেতেন তা ভোলার নয়। সবাইকে একসঙ্গে খাইয়ে আবার একসঙ্গে নামাজ পড়তেন।
‘উড়ে যায় বক পক্ষী’ হুমায়ূন আহমেদ আমাকে নাটকটি যখন করতে বলেছিলেন, তখন আমি কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম—করবো কি, করবো না। কারণ, তখন পর্যন্ত নাটকের একটি পর্ব লেখা হয়েছিল। যাতে আমার চরিত্রটির খুব একটা ব্যপ্তি ছিল না। আমাকে আরেকজন অভিনেতা বললেন, হুমায়ূন আহমেদ নিজে যখন বলছেন, তখন যেন অবশ্যই করি। তার কথায় রাজি হলাম। নাটকটির মূল চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা মাসুম আজিজ অভিনয় করেছিলেন। তিনি নানা কারণে সময় দিতে পারতেন না। যার কারণে একসময় আমার চরিত্রের ব্যাপ্তি বাড়ান হুমায়ূন আহমেদ। তিনি আমার অভিনয় অনেক পছন্দ করেছিলেন। আর এখন তো দর্শকদের কাছে তৈয়ব চরিত্রটি অনেক পছন্দের। ফেসবুকে তো দেখি এর ক্লিপ প্রচুর মানুষ দেখছে।
তাকে নিয়ে আমি বছর কয়েক একটি বই লিখেছি ‘স্মৃতি হুমায়ূন আহমেদ’। এবছর প্রকাশিত ‘আমার না বলা কথা’—তেও তার কথা এসেছে। সামনে লিখছি ‘ঘুম’, ‘মেঘেদের সংসার’—এগুলোতেও তার স্মৃতি এসেছে। আসলে আমি কিছু লিখলেই তার কথা আসবেই।
আমি ঢাকা থিয়েটার থেকে মঞ্চে ‘রঙমহাল’ নাটকটি পরিচালনা করছি। হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম দুদশক। সবমিলিয়ে আমি তার পরিচালনার কৌশল অনেকটাই জানি। সে জায়গা থেকে তার লেখা নিয়ে পরিচালনা করলে খারাপ করবো না বলে আমার বিশ্বাস। আমি চেয়েছিলাম তার লেখা ‘আয়না’ গল্পটি নিয়ে নাটক বানাতে। অনুমতি পাইনি। তবে কখনও পেলে বানাবো।
হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে শেষ স্মৃতি এখনো আমাকে কাঁদায়। তিনি তখন আমেরিকা থেকে কেমো দিয়ে দেশে এসেছেন কদিনের জন্য। আবার যাবেন চিকিৎসার জন্য। তখন একদিন ওনার ডাকে বাসায় গেলাম। সেখানে উপস্থিত সবার সামনে উনি বললেন, ‘আমি একটা গল্প বলবো।’
উনি তো প্রচুর গল্প বলতে পছন্দ করতেন। তিনি বললতে শুরু করলেন, একবার আমার ছোট ছেলের জন্মদিন। আমার কাছের সবাইকে দাওয়াত দিতে একজন দায়িত্ব দিলাম। গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠান। যাকে দায়িত্ব দিলাম, সে হয়তো ফারুককে দাওয়াত দিতে ভুলে গেছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন দেখি ফারুক সন্ধার সময় একটা উপহার নিয়ে হাজির। এসে বললো, ‘হুমায়ূন ভাই, আপনিতো আমাকে দাওয়াত দেন নাই, আমি কিন্তু চলে এসেছি’। এটাকে কি বলে জানো? ‘ভালোবাসা। সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।’
তারপর দেখলাম, ওনার চোখে পানি। তিনি চশমাটা খুললেন, চোখ মুছলেন। বললেন, ‘এখন তো অনেক রাত হয়েছে। ঢাকায় যাও। গুড বাই, ফারুক।’ আমিও তাকে বিদায় জানিয়ে আসলাম। কিন্তু সেটা যে শেষ বিদায় তা জানতাম না।