কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার জেতার পর নিজ দেশ ইরানে ফিরে অভিনন্দনে সিক্ত হলেন পরিচালক জাফর পানাহি। প্রতিশোধমূলক থ্রিলার ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবির জন্য স্বর্ণপাম জয়ের দুই দিন পর সোমবার তেহরানের ইমাম খোমেইনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। ছবিটিতে ইরানে কারাগারের ভেতর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারোঁ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এর এক পোস্টে জাফর পানাহির ছবিটিকে ইরান সরকারের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইরান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ কারণে ফ্রান্স ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধ দেখা দিয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আইআরএনএ (ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তেহরানে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল ইরান সরকার। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ তানহাই দাবি করেন, ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য অপমানজনক ও ভিত্তিহীন।

ইরানের প্রেসটিভির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের সময় মোহাম্মদ তানহাই ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যকে ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পষ্ট হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরো বলেন, ইরান প্রসঙ্গে মন্তব্য করার কোনও নৈতিক অধিকার নেই ফ্রান্সের। গাজায় ফিলিস্তিনিদের সহায়তায় ফ্রান্সের ব্যর্থতা তুলে ধরেন তিনি।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বর্ণনায়, জাফর পানাহির স্বর্ণপাম জয়ের ঘটনায় ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারোঁ’র প্রতিক্রিয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উস্কানিমূলক। ফ্রান্স সরকারের কাছে এর আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দাবি করেছেন তিনি। ফরাসি রাষ্ট্রদূত প্যারিসে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেন তাকে।

ইরান সরকার জাফর পানাহিকে একাধিকবার কারাদণ্ড দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সরকারের সমালোচনাকারী দুই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কারণে সর্বশেষ কারাবাস করতে হয়েছে তাকে। ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবিটি তার কারাবন্দি থাকার ঘটনায় অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মী। ইরানে গোপনেই এর দৃশ্যধারণ করেছেন তিনি।
সরকারবিরোধী বিক্ষোভকে সমর্থন ও দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে জাফর পানাহিকে ২০১০ সালে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও দেশত্যাগের ওপর ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ইরান সরকার। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার আগে তিনি সাত মাস কারাবন্দি ছিলেন।
এবারের আসরের মাধ্যমে ২২ বছর পর কান উৎসবে সশরীরে অংশ নিতে পেরেছেন জাফর পানাহি। মাঝে ২০১১ সালে জন্মদিনের কেকের ভেতর লুকানো একটি ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ইরান থেকে পাঠানো তার পরিচালিত ‘দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম’ কান উৎসবে বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়। ২০১৮ সালে তার আরেক ছবি ‘থ্রি ফেসেস’ সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছে কান উৎসবে। এসব আসর চলাকালে তার ওপর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার থাকার কারণে তাকে ছাড়াই চলচ্চিত্র দুটির প্রদর্শনী হয়েছে।

ইউরোপের প্রধান তিনটি চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার জয়ের বিরল কীর্তি গড়েছেন জাফর পানাহি। ৬৪ বছর বয়সী এই পরিচালককে বিমানবন্দরে বন্ধুদের আলিঙ্গন করার সময় মুখে হাসি ও হাতে ফুলের তোড়া ধরে থাকতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে ছিলেন ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক মেহেদী নাদেরি। তিনি ইনস্টাগ্রামে সেই মুহূর্তের ভিডিও পোস্ট করে জাফর পানাহির প্রত্যাবর্তনকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী হিসেবে অভিহিত করেন।
জাফর পানাহি তেহরানে ফিরে কান উৎসবে সাংবাদিকদের দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘উৎসবে আমার কাজ শেষ হলেই দেশে ফিরে যাবো। এরপর নিজেকে জিজ্ঞাসা করবো পরবর্তী ছবি কী নিয়ে বানাবো।’
জানা গেছে, জাফর পানাহি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এক ব্যক্তি চিৎকার দিয়ে বলেন ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। ২০২২ সালে দেশটির পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরান জুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের স্লোগান ছিল এটি। হিজাব না পরার অভিযোগে ২২ বছর বয়সী ওই তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

স্বর্ণপাম জয়ের পর কান-মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইরান সরকারের বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কথা বলেন জাফর পানাহি। তার মন্তব্য, ‘এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের দেশ ও আমাদের দেশের স্বাধীনতা। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের কী ধরনের পোশাক পরা উচিত, কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয়, সেসব বলার সাহস কারোরই থাকা উচিত নয়।’
ইরান সরকারের সহিংসতা ও বর্বরতা তুলে ধরা ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবিতে পাঁচজন সাধারণ ইরানি নাগরিকের গল্প বলা হয়েছে, যারা জেলের নির্যাতনকারী এক ব্যক্তির মুখোমুখি হয়। লোকটি নকল পা নিয়ে চলাফেরা করে। তবে তিনিই সেই নির্যাতনকারী কিনা সেটি যাচাই করতে সতীর্থ কয়েদিদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাহিদ নামের এক ভুক্তভোগী।