এশা মার্ডার: নারীর দৃষ্টিতে খুলে পড়ে শহুরে মুখোশ

আবু শাহেদ ইমন
5 Min Read
'এশা মার্ডার: কর্মফল' ছবির পোস্টার, ফেসবুক পেজ

সানি সানওয়ার পরিচালিত ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ কেবল একটি ক্রাইম থ্রিলার নয়—এটি বাংলাদেশের প্রচলিত ঘরানার বাইরে এক সাহসী পদক্ষেপ। চড়া আবেগ বা অতিনাটকীয়তা এড়িয়ে এই চলচ্চিত্রটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং সেই সামাজিক ও মানসিক সহিংসতার উৎস খুঁজে বেড়ায় যা এই হত্যার জন্ম দেয়। দেখা যাবে, একধরনের ধীরগতির কিন্তু গভীরভাবে আকর্ষণীয় তদন্ত—যেখানে গল্পের ভেতরেই ধরা পড়ে সমাজের অভ্যন্তরীণ পচন।

চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন লীনা—নতুন বদলি হয়ে আসা এক নারী পুলিশ কর্মকর্তা, যাকে পর্দায় প্রাণবন্ত ও সংবেদনশীল অভিনয়ে তুলে ধরেছেন আজমেরী হক বাঁধন। তার আবির্ভাব নায়িকাসুলভ নয়, বরং নিরব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। ঈশা নামের এক তরুণীর (অ্যাগনেস পূজা ক্রুজ অভিনীত) বিকৃত লাশ উদ্ধারই লীনার প্রথম তদন্ত। শহর কেঁপে ওঠে, শিরোনামগুলো চিৎকার করে, আর লীনা নাটকীয় কোনো প্রতিভায় নয়, বরং একজন জনসেবকের ধৈর্য নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করেন সত্য উদঘাটনের কাজ, যিনি জীবনের ক্ষত বহন করছেন গোপনে ।

সানি সানওয়ার (যিনি বাস্তবেও একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন) এবং হাসনাত বিন মতিনের সহলিখিত চিত্রনাট্যের বিশেষত্ব হলো—লীনা চরিত্রটি কোনো অলৌকিক গোয়েন্দা নয়। বরং তিনি দুর্বল হন, ভয় পান, দ্বিধায় থাকেন এবং পুরুষ সহকর্মীদের কাছেও উপেক্ষিত হন। তার মানসিক ভেঙে পড়া বা এশার মৃতদেহ দেখে বমি করে ফেলা কোনো দুর্বলতা হিসেবে নয়, বরং মানবিকতার প্রকাশ হিসেবেই উঠে আসে। এখানেই এই চলচ্চিত্রের আসল শক্তি—ক্ষমতার মুখোশ খুলে, একটি বাস্তব ও অস্বস্তিকর সত্যকে উন্মোচন করা।

প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা বলছেন আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: টাইমস

তদন্তের ধারা বাস্তব এবং মন্থর—অপেক্ষাকৃত জটিল ও হতাশাজনক, যেমনটি আসল জীবনে বিচারপ্রক্রিয়া হয়। সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছেন—এক অস্থির প্রকৃতির মেকানিক নাসির (শরীফ সিরাজের চুপচাপ কিন্তু ভীতিকর অভিনয়), এক নিশ্চুপ প্রেমিক (নিবির আদনানের সংযত অভিনয়), এক কামুক বাড়িওয়ালা (সতাব্দী ওয়াদুদের দারুণ রূপান্তর), এবং আরও একাধিক নৈতিকভাবে অস্পষ্ট পুরুষ চরিত্র—যারা সবাই ভিন্ন মাত্রার কোনো না কোনো  অপরাধে জড়িত।

তবে সবচেয়ে শীতল উপস্থিতি সাঈদ আজাজ আহমেদের—যিনি খুব কম সময় পর্দায় থেকেও তার নিষ্ঠুর হাসিতে পুরো আবহকে শাসন করেন। তার নীরব অভিনয় অনেক ‘ভিলেনের’ দীর্ঘ সংলাপের চেয়েও বেশি ছায়া ফেলে।

চলচ্চিত্রটি আলাদা করে তুলে ধরে তার নির্মাণশৈলীতে। সিনেমাটোগ্রাফার সুদীপ্ত মজুমদার তুলে ধরেছেন ধুলোবালি মাখা, বিবর্ণ এক বাস্তবতা—যেখানে গ্রাম্য রাস্তা ফেটে আছে, থানাগুলো অবহেলিত, আর সকালও যেন আসে আশঙ্কার ছায়া নিয়ে। আর্ট ডিরেকশন (তারেক বাবলু) ও কস্টিউম ডিজাইন (ফারজানা সান) বাস্তবতাকে দৃশ্যমান করে তোলে—লীনার পরিধান যেমন থাকে, সাধারণ, ব্যবহার্য, কখনো-মাঝেমধ্যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

শিল্পী ও কলা-কুশলীদের মাঝে আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: টাইমস

প্রসেনজিৎ ব্যানার্জির রঙের ব্যবহার যেন এক বিবর্ণ নৈতিকতার প্রতীক—সবুজ প্রকৃতিও যেন ম্লান, শুষ্ক, বিবর্ণ। এই ভিজ্যুয়াল টোন পুরো চলচ্চিত্রের বিষণ্ণ আবহকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে।

মৃণ্ময় সান্যালের আবহসঙ্গীতও তেমনি সংযত। নীরবতা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে শব্দ অনুপস্থিত—ভয় ও অস্বস্তির অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ‘বন্দি শুধু জানে মুক্ত হবার মানে’ গানটি যেন ছবির আত্মাকে ছুঁয়ে যায়—এখানে লড়াই স্বাধীনতার জন্য নয়, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে।

সহকারী অভিনেতারাও দারুণ: সুষমা সরকার, শিল্পী সরকার অপু, হাসনাত রিপন, ও সুমিত সেনগুপ্ত তাঁদের চরিত্রে বিশ্বস্ততা আনেন। মিশা সওদাগর এক বেকারি মালিকের ভূমিকায় সাবলীল, যদিও তার কণ্ঠ ডাবিং করা হওয়ায় বাস্তবতা একটু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ ছবির পোস্টার, ফেসবুক পেজ

চলচ্চিত্রে সমাজচিত্র স্পষ্ট: বিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন, এবং বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিকতার দীর্ঘমেয়াদি মানসিক খেসারত গল্পের ভেতরে চুপিসারে গাঁথা, কোনো সময় জোর করে নীতিকথা শোনানো নয়। শেষ দৃশ্যে ‘কর্মফল’ শব্দটির আসল তাৎপর্য প্রকাশ পায়—প্রতিশোধ ও ন্যায়বিচার যখন একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, আর প্রকৃতি তখন তুলে নেয় সেই বোঝা, যা প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যর্থ হয় ধারণে।

তবে কিছু জায়গায় দুর্বলতাও আছে। যেমন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে’কে কেন্দ্র করে অপরাধের একটি ধারার ব্যাখ্যা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, যেন একটু তাড়াহুড়া করা হয়েছে। আর ফ্ল্যাশব্যাক কাঠামো আরও কিছুটা ছাঁটাই করলে প্রথম অংশের পুনরাবৃত্তি কমত।

তারপরও, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ এমন একটি খুনের গল্প, যা সহিংসতাকে রোমান্টিক করে না, পুলিশদের গ্ল্যামারাইজ করে না, এবং দর্শককে শিশুসুলভভাবে ধরেও ব্যাখ্যা করে না। বরং দর্শকের বোধ, অনুভব ও বিচারবোধে আস্থা রাখে। যেখানে নারীরা প্রায়শই পর্দায় কেবল ভিকটিম বা প্রেমিকা হয়, সেখানে লীনা চরিত্রটি নিজের ক্ষতসহ একাই পুরো চলচ্চিত্রকে বহন করেন।

আজমেরী হক বাঁধনের প্রত্যাবর্তন দুর্দান্ত। আর সানি সানওয়ার শুধু দক্ষ পরিচালক হিসেবে নয়, একজন সত্য-বক্তা নির্মাতা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন—যার সাহস আছে, আর আছে সংযম।

 ক্রেডিটস_________________

চলচ্চিত্র: এশা মার্ডার: কর্মফল, পরিচালনা ও কাহিনি: সানি সানওয়ার, সহলেখক: হাসনাত বিন মতিন, সংলাপ: শাহজাহান সৌরভ, অভিনয়: আজমেরী হক বাঁধন, পূজা অ্যাগনেস ক্রুজ, সুমিত সেনগুপ্ত, মিশা সওদাগর, সতাব্দী ওয়াদুদ, ফারুক আহমেদ, নিবির আদনান, সরকার রউনক রিপন, সুষমা সরকার, শিল্পী সরকার অপু, হাসনাত রিপন, চিত্রগ্রহণ: সুদীপ্ত মজুমদার, সম্পাদনা: প্রণয় দাশগুপ্ত, সংগীত: মৃণ্ময় সান্যাল, শিল্প নির্দেশনা: তারেক বাবলু, আহমেদ হুমায়ুন, জাহিদ নিরব, পোষাক: ফারজানা সান, সাউন্ড ডিজাইন: তীর্থঙ্কর মজুমদার, প্রযোজনা: মো. মাসফিকুর রহমান ও ফারুক রায়হান, প্রযোজনা সহযোগী: কপ ক্রিয়েশন, বিঞ্জ ও লিডস এন্টারটেইনমেন্ট।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *