তিন দিনের সরকারি সফরে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। দেশটির এ পর্যায়ের কোনো মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের এই ঘটনা ঘটল দীর্ঘ ১৩ বছর পর।
এই সফরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইসহাক দার। এসব বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব এবং তা মোকাবেলার প্রসঙ্গ টানেন বলে জানিয়েছেন দলগুলোর কয়েকজন নেতা।
ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। বৈঠকে ঢাকা-ইসলামাবাদ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয় উঠে আসে। পাশাপাশি পাকিস্তানি প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী ছিলেন বলে জানিয়েছেন বৈঠকগুলোয় অংশ নেওয়া নেতারা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হয়। তবে সেটা হয় বিএনপি ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠকে। একাত্তরের বিষয় অবশ্যই সমাধান করা উচিৎ বলে উল্লেখ করেন দুই দলের প্রতিনিধিরা। এতে অবশ্য ইসহাক দার তেমন আগ্রহ দেখাননি। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের ওপর ভবিষ্যতে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সীমিত করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
এনসিপির সঙ্গে বৈঠক
২৩ আগস্ট বিকালে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনে ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপির একটি প্রতিনিধিদল। এতে নেতৃত্ব দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন নেতা জানান, ভারতীয় আধিপত্য এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে তাদের প্রভাব সীমিত করার বিষয়টির ওপর ‘বিশেষভাবে’ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা।
তিনি বলেন, ‘আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে জোরালো আলোচনা করেছিলাম, কিন্তু ইসহাক দার তাতে তেমন মনোযোগ দেননি।’
বৈঠক শেষে আখতার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে যখনই আলোচনা হয়, তখনই ১৯৭১-এর বিষয়টি উঠে আসে। আমরা সার্ক নিয়েও আলোচনা করেছি।’
তবে ভারতীয় প্রভাবের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠক
একইদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তান হাইকমিশনে ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ শীর্ষ নেতারা।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন দুই নেতার (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) সঙ্গে কথা হয় টাইমস অব বাংলাদেশের। তারা জানান, অন্যান্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল ভারত বিষয়ে বিএনপির অবস্থান জানার চেষ্টা করছিল।
দলটির এক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘তিনি (ইসহাক দার) ভারত সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান জানাতে চেয়েছিলেন, বিশেষ করে বিএনপি এ সম্পর্ক কতটা এগিয়ে নিতে চায় সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে চান দার।’
এমনকি ভারতকে বাদ দিয়ে সার্ক পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব কি না–এমন আলোচনাও করেন ইসহাক দার।
জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক
এই বৈঠকে দুই পক্ষ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জুলাই মাসের উত্থান ও আসন্ন সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা করে। তবে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি কোনো পক্ষই উত্থাপন করেনি।
জামায়াতের প্রতিনিধিদলের নেতা নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে। এ সময় আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং সম্পর্কের আরও সম্প্রসারণের পথ নিয়েও আলোচনা হয়।’
১৯৭১ সালের অমীমাংসিত প্রসঙ্গে তিনি টাইমসকে বলেন, ‘এটি দুই সরকারের বিষয়। আমরা সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই।’
পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার বৈঠকে জামায়াতের ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে ভূমিকা সম্পর্কেও প্রশ্ন করেছিলেন।
দলটির একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ভারতের বিষয়ে, ভারতের আধিপত্যবাদী প্রবণতার ক্ষেত্রে জামায়াত তাদের সতর্ক অবস্থান সম্পর্কে বৈঠকে স্পষ্ট করেছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দলটি পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছিল এবং দলের অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যায়ও জড়িত ছিলেন। এই অপরাধে শেখ হাসিনা সরকারের সময় কয়েকজন নেতাকে ফাঁসিও দেওয়া হয়।
এমনকি মুক্তিযুদ্ধ পরিবর্তী সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে জামায়াত। তাই ইসহাক দারের সফর ও তার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি জামায়াতের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয়।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়েছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে। ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল।
অতীতে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কও শীতল ছিল। তবে ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করছে বিএনপি।
*প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এম সাইফুল ইসলাম এবং বিশেষ প্রতিবেদক মোসাররফ বাবলু।