সাথিরা জাকির জেসি, বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অফ স্পিনার। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি বড় নয়, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট মিলিয়ে খেলেছেন মাত্র তিন ম্যাচ। যদিও এশিয়ান গেমস ও দ্বিপাক্ষিক সিরিজ মিলিয়ে আরো কিছু ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে দেখা গেছে তাকে। অবশ্য সেসব ম্যাচের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। তবে তার আলাদা এক স্বীকৃতি আছে, যা কেড়ে নিতে পারবে না কেউই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম নারী আম্পায়ার।
জাতীয় দলের লাল সবুজ জার্সি গায়ে চাপিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেননি। খেলা হয়নি বিশ্বকাপ কিংবা নিদেনপক্ষে এশিয়া কাপের মতো টুর্নামেন্টেও। তবে এবার তার বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ভারত ও শ্রীলংকা মিলিয়ে শুরু হতে যাওয়া নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশী নারী আম্পায়ার হিসেবে থাকছেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে মাঠের লড়াইয়ে থাকবেন নিগার সুলতানা জ্যোতিরা। আর তাদেরই ম্যাচ পরিচালনা করবেন জেসি। অথচ ২০২২ সালেও ঘরোয়া ক্রিকেটের তৃতীয় ডিভিশনে আম্পায়ারিং করেছেন। এর আগে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে পুরুষদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করেন শরফুদ্দৌলা সৈকত।
দারুণ এই খবরটা জানার পর জেসিকে মুঠোফোনে ধরতে অবশ্য খানিকটা বেগই পোহাতে হয়েছে। এই প্রান্ত থেকে অভিনন্দন জানাতে খুশি হয়ে পাল্টা ধন্যবাদ দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু গাড়ি চালানোতে ব্যস্ত থাকায় কথা আর বেশি এগোতে পারেননি এই প্রতিবেদক।
জেসির ক্রিকেটে আসার গল্পটা বেশ ভিন্নই বলা চলে। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হয়েছিলেন শুটিংয়ে। কারণ মেয়েদের ক্রিকেটের কোনো ডিসিপ্লিন তখন বিকেএসপিতে ছিল না। যদিও ২০০৭ সালে নারী ক্রিকেট দলের যাত্রা শুরুর পর জেসিও নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন ক্রিকেট মাঠেই।
নানান সীমাবদ্ধতায় জর্জরিত নারী ক্রিকেট দলের হয়ে যখন পথচলা শুরু করেন, তখন সামাজিক দিক থেকেও নানান কটু কথার স্বীকার হতে হয়েছে। মেয়েদের ক্রিকেট খেলাকে রীতিমতো দেখা হতো বাঁকা চোখে। যদিও সীমিত সুযোগ সুবিধা আর ভংগুর নারী ক্রিকেটের কাঠামো নিয়েও ক্রিকেটের লড়াই চালিয়ে গেছেন জেসি-সহ শুরুর দিককার ক্রিকেটাররা।
জাতীয় দলের ক্যারিয়ার না এগোলেও রংপুরের বিভাগীয় দলের হয়ে লিস্ট ‘এ’ ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচে খেলেছেন একটা লম্বা সময়। ২০১২ সালে বিয়ের পর আর জায়গা হয়নি জাতীয় দলে। তৎকালীন কোচিং প্যানেলের ওপরও দায় দিয়েছেন সাবেক এই ক্রিকেটার। তবুও দমে যাননি, সন্তান জন্মদানের মাস তিনেকের মাঝেই আবার মাঠে ফিরেছেন। ক্রিকেটের জন্য নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন সে কথা বলাই যায়।
অবশ্য খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারেই আম্পায়ারিংয়ের কোর্স সম্পন্ন করে রেখেছিলেন জেসি। যদিও তখন নারী আম্পায়ারদের নিয়ে বিসিবির তেমন কোনো পরিকল্পনা না থাকায় খুব বেশি এগোতে পারেননি। যদিও বিভিন্ন টিভি শোতে হোস্টিং, ধারাভাষ্য দিয়েও ক্রিকেটের সাথে যুক্ত ছিলেন একটা লম্বা সময়। ক্রিকেটের সাথে জুড়ে থাকার সকল চেষ্টাই করেছেন জেসি, লেভেল টু কোচিং সার্টিফিকেটও তার আছে।
যদিও জেসির জীবনের মোড় ঘুরিয়েছে আম্পায়ারিংই। ২০২২ সালে থার্ড ডিভিশনে আম্পায়ারিং শুরু। গত মৌসুমের ঢাকা লিগেও ছেলেদের ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আয়ারল্যান্ড নারী দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের সাদা বলের দুটো সিরিজেও দায়িত্ব সামলেছেন। তবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ব্রেক থ্রুটা পেয়েছেন ২০২৩ সালের মেয়েদের এমার্জিং এশিয়া কাপে। এরপর একে একে জেসির সামনে সুযোগ এসেছে নারীদের বয়সভিত্তিক এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মঞ্চেও। কদিন আগে ভারতের লেজেন্ডস লিগ ক্রিকেটেও দাঁড়িয়েছেন সেন্টার উইকেটের নন স্ট্রাইকিং এন্ডের পেছনে। আর ২০২৪ সালে নারীদের এশিয়া কাপ তো এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বড় অর্জন আম্পায়ার হিসেবে। সেই ধারাবাহিকতায় সুযোগ পেতে যাচ্ছেন মেয়েদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে।
জেসির পথ ধরে আরো কয়েকজন নারী এসেছেন আম্পায়ারিংয়ে। বিসিবি থেকেও যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন পাচ্ছেন তারা। আছেন বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে। বেতন পাচ্ছেন, বিভিন্ন পর্যায়ে ম্যাচ পরিচালনা করছেন, অংশগ্রহণ থাকছে তাদের বিভিন্ন ওয়ার্কশপেও। জেসির সাথে আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল আম্পায়ার প্যানেলে আছেন চম্পা চাকমা, রোকেয়া সুলতানা, ও ডলি রাণী সরকার। এই তালিকাটা আরো লম্বা হবে বলেই আশা দেশের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের।