‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’– এটি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি বিখ্যাত উক্তি। বলা ভাল, এটি শুধু আপ্তবাক্য নয়, এর ভেতরে রয়েছে গভীরতর দর্শন। রাষ্ট্রীয় জীবনে যদি কোনো জাতি তার স্বপ্নদ্রষ্টাকেই অপমান করে, তবে সে জাতি বোধহয় নিজের উচ্চতাও খাটো করে ফেলে।
মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে, তা জাতির বিবেক, সম্ভাবনা ও সম্মানবোধের এক জটিল আবর্তও বটে।
এ পর্যায়ে জাতির ভবিষ্যৎ কি শুধুই পরিসংখ্যান আর রাজনীতির কূটকৌশলে নির্ধারিত হবে? না কি নৈতিক সাহস ও আত্মসম্মানের ভিত্তিতে গঠিত হবে? রাষ্ট্রের মুখোমুখি এখন এই জটিল প্রশ্ন।

বিশ্বে তার সুখ্যাতি ছড়িয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব, ‘সোশ্যাল বিজনেস’ মডেলের উদ্ভাবক, ‘জিরো থ্রি’ ত্বত্ত্বের প্রবক্তা এবং এক নতুন অর্থনৈতিক বার্তাবাহক হিসেবে। অথচ নিজের দেশেই তিনি যেন আজ ‘রক্তকরবী’র রাজা, রাজনৈতিক ‘দোষারোপচক্রের’ মধ্যমণি ।
যে জুলাই অভ্যুত্থান ফ্যাসিজমের অবসান ঘটিয়ে ইউনূসকে বসিয়েছে ক্ষমতার বাঘের পিঠে, ক্ষমতা থেকে সহসা সরে গেলে সেই বাঘ বুঝি তাকে গিলে ফেলবে যখন-তখন।
প্রথমত, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্থানকে কেন্দ্র করে ‘কিংস পার্টি’ হ্যাশট্যাগে যে সমালোচনার সূচনা, তা একই সঙ্গে জন্ম দিয়েছে পক্ষপাতের অভিযোগও।
ইউনূস সরাসরি এনসিপির কর্মকাণ্ডে জড়িত নন, কিন্তু সম্প্রতি তার সরকারের ‘পদত্যাগের’ ভাবনার কথা প্রথম জানতে পারেন, এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম। শুধু তাই নয়, বিবিসি বাংলাকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের ‘আস্থাহীনতার’ কথা জানিয়ে রীতিমতো দেশে-বিদেশে তোলপাড়ও ফেলেন। আবার এই ‘তোলপাড়’ প্রশমিত করতে এ সরকারের প্রয়োজন পড়ে দফায় দফায় রাজনৈতিক সংলাপ।
প্রকাশ্য এই রাজনৈতিক সখ্য একই সঙ্গে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তিনি কি আদৌ ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখছেন, নাকি সুবিধাভোগী এক বলয়ের ভেতরে হয়ে উঠেছেন ‘ডিভিশনের কয়েদী’?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘সম্মান সেই পায়, যাহার ন্যায়বোধ আছে’। সরকার প্রধানের এই ন্যায়বোধই যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে তার সন্মানিত আসনটিও হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় চীন ও ভারতকে ঘিরে ‘রাখাইন করিডোর’ ইস্যুতে ইউনূস সরকারের ভূমিকা অনেকেই দুর্বল মনে করছেন। নিঃসন্দেহে এর নেপথ্যে রয়েছে এ সরকারের ওপর এ নিয়ে দেশি-বিদেশি চাপ।

‘করিডোর’-এর প্রশ্নে শুরুতে সম্মতির ইঙ্গিত দিয়ে পরে পিছু হঠার ফলে নেতৃত্বের নড়বড়ে অবস্থানকে জাতির সামনে প্রকট করে তুলেছে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘যে জাতির সম্মান থাকে না, তার স্বাধীনতা নিছক দানবীর্যের ফল।’ এমন আবহে ইউনূসের পশ্চাদপসরণ যেন অনিবার্যই ছিল। কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সার্বভৌম সম্মান ও প্রতিরোধশক্তির প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টাদের সাথে এনসিপির নীরব ‘দহরম-মহরম’ এবং এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন ‘আশকারা’ ইউনূস জামানার ‘নিরপেক্ষতা’কে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে গত ২ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ মতবিনিময়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একই কাতারে বৈঠক বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতরে গড়ে ওঠা শেষোক্ত দলটির বয়স মাত্র চার মাস! আর দলটির নেতাদের রাজনৈতিক পরিপক্কতার বিষয়টি না অপ্রসঙ্গই রইল।
তো এনসিপি নিয়ে এই ‘পক্ষপাতিত্ব’, তথা বিএনপি-জামায়াতের মত তাদেরও সমান গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি সরকারের ‘নৈতিকতাকে’ প্রকটভাবে প্রকাশ্য করেছে।
‘ইউনূস যদি ব্যর্থ হন, সেটা রাজনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু তাকে হেয় করা মানে, দেশের গৌরব হেয় করা’– বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের এই মন্তব্যটি গভীরভাবে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর মুহাম্মদ ইউনূস হয়ে উঠেন এক বিকল্প স্বপ্নের বাহক—যাকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আরো মানবিক ও আরো প্রগতির পথে হাঁটবে, এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশবাসী, তাদের এই সোনালি স্বপ্নকে পিষে ফেলার মানে হচ্ছে সম্ভাবনার শেষ আলোটুকুও নিভিয়ে দেওয়া।
তাই হাজারো জুলাই যোদ্ধার প্রাণের বিনিময়ে গড়ে ওঠা দেশ গঠনের স্বপ্ন, গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন– এতো সহজেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না।
ইউনূস বিতর্ক আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কোনো জাতির গৌরব রক্ষা শুধু রাষ্ট্র এবং রাজনীতিবিদদের নয়—তার নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ারও দায়িত্ব রয়েছে। এখন প্রশ্ন, নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আমরা কি সেই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছি? আর ইউনূসের ব্যর্থতার ইতিহাস হয়তো একদিন আমাদেরকেই জিজ্ঞাসা করবে, ‘তুমি কি তখন প্রতিবাদ করেছিলে, না নীরবে সম্মতি দিয়েছিলে?’
জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেন, ‘যারা স্বপ্ন দেখি, তারা জানি—স্বপ্ন কখনোই মরে না, শুধু সময় চায়।’ তাই আরও কিছুটা স্বপ্নের পথ চলা এখনও বাকি। আর সে জন্য চাই মুহাম্মদ ইউনূসকে দৃঢ় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে দেখতে।