২০০০ সালের নভেম্বরের এক সকাল। হেমন্ত শেষে প্রকৃতি গাইছে শীতের আগমনী গান। বর্ণিল সাজে সজ্জিত বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। সেখানে গ্যালারিভর্তি দর্শক। হাতে হাতে পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার; তাতে দলের জন্য লেখা শুভকামনার বার্তা। ১০ নভেম্বর সেই শুভকামনা-সমর্থন রূপ নেয় হর্ষধ্বনি আর উল্লাসে, ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেটের মচ্ছব হয়ে। উপলক্ষ— বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট।
এর মাস ছয়েক আগে এসেছিল ক্রিকেটকে উৎসবে পরিণত করার খবর। দশম দেশ হিসেবে ২০০০ সালে ২৬ জুন টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল বাংলাদেশ। পা দিয়েছিল এক নতুন ধাপে। যেখানে কেবল ‘এলিট’ সদস্যরাই খেলার যোগ্য। টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত সেই রাজপথে পথচলার রজতজয়ন্তী পূর্ণ হলো ২০২৫ সালের ২৬ জুন এসে।
ঐতিহাসিক এই দিন পালন করতে বৃহস্পতিবার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে একত্রিত হয়েছিলেন অভিষেক টেস্টের স্কোয়াডে থাকা বেশিরভাগ ক্রিকেটার। যাদের একজন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, দেশের প্রথম এই টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতিও। তারই আমন্ত্রণে বাকিদের সাথে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট কোচ সারওয়ার ইমরান আর টিম ম্যানেজার আজিজ আল কায়সারও। বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়েছে অভিষেক টেস্ট দলের সব সদস্যকে। বিসিবির দেয়া বিশেষ ব্লেজার গায়ে চাপিয়ে আড্ডাচ্ছলে করেছেন প্রথম টেস্টের স্মৃতিচারণও।

ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের পর সময়স্রোতে ভেসে এই ২৫ বছরে বদলেছে কত কিছু। প্রথম টেস্টের ভেন্যুর নাম পাল্টে গেছে, সেই মাঠ এখন পুরোদস্তুর ফুটবলের। যুগ বদলের স্বাক্ষী হিসেবে অনেক কিছুই উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এই ২৫ বছর টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের উন্নতির স্মারক কী? টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার প্রথম ২৫ বছরে বাংলাদেশের জয় মাত্র ২৩টি। এখন পর্যন্ত ১৫৪ ম্যাচের ১১১টিতে মাঠ ছাড়তে হয়েছে হার সঙ্গী করে।
যৎসামান্য যে সাফল্য এসেছে, হাতের কড়েতে গুণে বলে দেওয়া যায়। বাংলাদেশের উন্নতির প্রশ্নে তাই একেবারেই সন্তষ্ট হয়ে উত্তর দিতে পারেননি প্রথম টেস্টের স্কোয়াডে থাকা রাজিন সালেহ। কতটা এগোল বাংলাদেশ লাল বলের ক্রিকেটে?
উত্তরে ‘টাইমস অফ বাংলাদেশ’কে সাবেক এই ক্রিকেটার বলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে আমরা এখন নবম অবস্থানে আছি। সত্যি বলতে টেস্টে আমরা এখনো ওভাবে এগোতে পারিনি। ২৫ বছরে মোট ২৩টি টেস্ট জিতেছি, সাথে কয়েকটা সিরিজ। আমরা টেস্টে আগাতে পারিনি, তলানিতেই আছি। আমাদের অনেক কোয়ালিটিফুল কিছু ক্রিকেটার এলেও দল হিসেবে উন্নতি করতে পারিনি।’
যে স্বপ্নের শুরুটা বুলবুল, আকরাম খান, হাবিবুল বাশার সুমনরা করেছিলেন, সেই স্বপ্নের বিপরীতে প্রত্যাশা কতখানি পূরণ করল বাংলাদেশ? অভিষেক টেস্ট খেলতে না পারলেও স্কোয়াডে থাকা রাজিন সোজা জবাবেই জানালেন, আরো উন্নতির জায়গা দেখেন তিনি।

২৪ টেস্ট আর ৪৩ ওয়ানডে খেলা সাবেক ডানহাতি ব্যাটার রাজিন বলেন, ‘আমরা, বাশার ভাই, পাইলট ভাইরা যখন খেলা ছাড়লাম, এরপর তামিম-সাকিবরা দলে ঢুকেছে। শুরুতে স্ট্রাগল করলেও বেটার ক্রিকেট খেলেছে। আমরা যে আশা নিয়ে ক্রিকেট ছেড়েছিলাম, দলের ওপর টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, ওই আশা পূরণ হয়নি। আশা ছিল টেস্ট র্যাংকিংয়ে চার-পাঁচের মধ্যে থাকবে দল, সেই জায়গাটায় যেতে পারিনি। ২৫ বছরে দেশের টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে একদমই সন্তষ্ট না। আরো উন্নতির জায়গা দেখি।’
একই প্রসঙ্গে কথা হলো বাংলাদেশের টেস্ট দলের প্রথম কোচ সারওয়ার ইমরানের সাথেও। বিসিবিতে এসেছিলেন রজতজয়ন্তী উদযাপনের আমন্ত্রিত হয়ে। অন্যান্য দেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে দক্ষতা-সামর্থ্যের বিচারেও বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এই প্রধান কোচ।
অভিজ্ঞ এই কোচ বলেন, ‘আমাদের খেলোয়াড়রা ১৯-২০ বছর বয়সে দলে ঢুকে যায়। অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডে ২৪-২৫ বছরের আগে দলে ঢোকাটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। ওখানে ওরা অনেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে, নিজেকে প্রমাণ করে। আমাদের এখানে কী হচ্ছে? হয়তো অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ভালো খেলেছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে দুয়েকটা ম্যাচ ভালো খেলেছে তাকে সুযোগ দিয়ে দাও। কেউ পারছে না, তার জায়গায় ওকে সুযোগ দিয়ে দাও। ঠিক আছে সুযোগ দিন, কিন্তু জটিলতাগুলোও তো বিবেচনায় রাখতে হবে।’
সময়ের সাথে সাথে ১০৭ জন ক্রিকেটার বাংলাদেশের টেস্ট ক্যাপ তুলেছেন মাথায়। কিন্তু দলীয় পারফরম্যান্সে খুশি হওয়ার উপলক্ষ টেস্টে খুব কমই এসেছে। টেস্ট ক্রিকেটের একাল-সেকালের তুলনা করতে গিয়ে কোচ ইমরান আরো বলেন, ‘তখন আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হাবিবুল বাশাররা যেভাবে খেলত, এখনকার খেলার মধ্যেও তাদের সঙ্গে খুব একটা তফাত দেখি না।
রাজিন সালেহও লাল বলের ক্রিকেটে এগোতে না পারার প্রশ্নে দাঁড় করালেন ধারাবাহিকতার অভাব আর দল হিসেবে খেলতে না পারাকে। বিসিবির হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের এই ব্যাটিং কোচ বলেন, টিম হিসেবে পারফরম্যান্সে ঘাটতি আছে। আবার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে অনেক এগিয়ে। এখানে আবার আরেকটা জিনিস, একটা দলের হয়ে দীর্ঘ সময় চার-পাঁচজন খেলা ক্রিকেটার সরে গেলে, তাদের বিকল্প তৈরি করাও কিন্তু সময়ের ব্যাপার।’