পাহাড়ে ‘গণগ্রেপ্তার’ আতংক, এলাকাছাড়া ৩ হাজার পাহাড়ি

বিপ্লব রহমান
5 Min Read
পাহাড়ে অভিযানে গ্রেপ্তার নারী-শিশুসহ বনজনগোষ্ঠীর কয়েকজন। বান্দরবান আদালতচত্বরে তোলা সাম্প্রতিক ছবি, সংগৃহীত
Highlights
  • আটকদের মধ্যে দুইজন থ্যালাসেমিয়া রোগী, ২৫ নারী, তিনজন শিশুসহ শতাধিক বম রয়েছেন। তাদের মধ্যে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছেন লাল পেলেং কিং বম (২৭) নামে একজন।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্যদের ধরতে আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানকে কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছে চাপা আতংক।

অভিযোগ রয়েছে, অভিযানে ‘গণগ্রেপ্তারদের’ বেশিরভাগই ‘নিরীহ জুমচাষী গ্রামবাসী’। আর প্রকৃত সন্ত্রাসীরা অনেক আগেই সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে ভারতের মিজোরামে।

পাহাড়ের নেতৃত্ব পর্যায়ের মানুষেরা দাবি করছেন, গ্রেপ্তার এড়াতে গত একবছরে দুর্গম পাহাড়ে বম জাতিগোষ্ঠীর অন্তত ছয়টি গ্রাম হয়ে পড়েছে জনমানুষ শূন্য। শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।  এসব গ্রামের তিন হাজারেরও বেশি পাহাড়ি নারী-পুরুষ এলাকা ছেড়ে গেছেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কেএনএফের এক সশস্ত্র গ্রুপ রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ও পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র লুট করলে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় শুরু হয়  নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান। বছর খানেক ধরে চলা অভিযানে এ পর্যন্ত কেএনএফ সন্দেহে বম জাতিগোষ্ঠীর শতাধিক নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাসখানেক আগেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে খুমি জনগোষ্ঠীর এক স্কুল শিক্ষিকাকে।  গ্রেপ্তারদের রাখা হয়েছে বান্দরবান ও চট্টগ্রাম কারাগারে।

আটকদের মধ্যে দুইজন থ্যালাসেমিয়া রোগী, ২৫ নারী, তিনজন শিশুসহ শতাধিক বম রয়েছেন। তাদের মধ্যে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছেন লাল পেলেং কিং বম (২৭) নামে একজন।

বিভিন্ন সময় আটকদের মুক্তির দাবিতে বান্দরবান ও ঢাকায় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে থেকে বিভিন্ন নারী সংগঠন ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ নামে যে কর্মসূচি, সেখান থেকে নিরীহ বম নারী-পুরুষ-শিশুর নিঃশর্ত মুক্তি দাবির কথা বলেছেন চাকমা রাণী।

অস্থিরতার সূত্রপাত রুমায়

গত বছর ২ এপ্রিল। ওইদিন কেএনএফ-এর শতাধিক অস্ত্রধারী রাত সাড়ে ৮ টার দিকে রুমা উপজেলা বাজারের মসজিদ ও ব্যাংক ঘেরাও করে সবাইকে জিম্মি করে রাখে। এ সময় তারা স্থানীয় সোনালী ব্যাংকের ভল্ট থেকে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লুট করে। পাশপাশি তারা ছিনিয়ে নেয় ডিউটি পুলিশের ১০টি ও আনসার বাহিনীর ৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ করেও নিয়ে যায় তারা।

এরপর পরই সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারের পাশাপাশি লুন্ঠিত টাকা ও অস্ত্র উদ্ধারে রুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় পুলিশের নেতৃত্ব চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। এ অভিযানে ‘ধরপাকড়’ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

নাগরিক সমাজের প্রশ্ন

বান্দরবানের সিনিয়র সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা ওই অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

টাইমস অব বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘রুমায় ব্যাংক ডাকতি হয়েছিল গত বছর ২ এপ্রিল। ৮ এপ্রিল অভিযানে নামে যৌথ বাহিনী। অথচ ঘটনাস্থলের পাশে বেথেলপাড়ায় (বম জনগোষ্ঠীর গ্রাম) “দুঃসাহসিক অভিযানের” দল পৌঁছতে সময় লেগেছে ৬ দিন। নারী, শিশু, থ্যালাসেমিয়া রোগী, গর্ভবতী মা, তরুণ, বৃদ্ধ–যাকে বলে নির্বিচার গ্রেপ্তার চলেছে বেথেলপাড়ায়।’

বান্দরবানের এটিএন নিউজের প্রতিনিধি মিনারুল হক মনে করেন, যারা অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না অথবা আরও তদন্ত করে যারা অপরাধী নন, তাদেরকে জামিন দেওয়া উচিত। তার মতে, কারাগারে যারা রয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য সমস্যা হলে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘সে সময়ে (কেএনএফের ব্যাঙ্ক ডাকাতি ও অস্ত্র লুট) একটা অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল এটা ঠিক। কিন্তু কিছু অপরাধীদের জন্য পুরো বম জনগোষ্ঠী কষ্ট পাবে, এটি কেউ মানতে পারে না।’

‘আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা বারবার এ কথাই বলে আসছি সরকারকে। সে সময়ে অভিযুক্ত জঙ্গিদের যদি জামিন হতে পারে, যারা অপরাধী নয় তাদের কেন জামিন হবে না?’ প্রশ্ন করেন তিনি।

বম স্যোশাল কাউন্সিলের তথ্য

‘বম স্যোশাল কাউন্সিল’ পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, গত এক বছরে কেএনএফ বিরোধী অভিযান ও ধরপাকড়ে রুমা উপজেলার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে ছয়টি বম গ্রাম। এগুলো হচ্ছে—চাইক্ষং পাড়া, সালপি পাড়া, থিনডলতে পাড়া ফাইনুয়াম পাড়া, লাংমুয়াল পাড়া এবং তামলো পাড়া।

এসব গ্রামের তিন হাজার ২৫০ জনের বেশি নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন অন্য জায়গায়।

সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট বম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৩। তাদের সকলেরই বসবাস বান্দরবানে।

যা বলছে পুলিশ প্রশাসন

বান্দরবান পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার টাইমস অব বাংলাদেশের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, কেএনএফের রুমায় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের পর যৌথ বাহিনীর অভিযানের ভয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর অনেক লোকজন অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।

তবে তার দাবি, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে বম নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করায় তাদের অনেকে আশ্বস্ত হয়ে আবার ফিরেও এসেছেন।’

‘গণগ্রেপ্তারে নিরীহ গ্রামবাসী ধরপাকড়ের’ অভিযোগের প্রশ্নে এসপি শহিদুল্লাহ বলেন, ‘কেএনএফের ব্যাংক ও অস্ত্র লুটের মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। এ ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে কারা জড়িত, তা তদন্ত করে দেখার দাবি রাখে। তবে এ মামলায় নতুন করে কাউকে ধরা হয়নি।’

তিনি দায়িত্বগ্রহণের ছয় মাস আগে ওই গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয় জানিয়ে এসপি বলেন, ‘অবশ্যই নিরীহ গ্রামবাসী যেন হয়রানি ও গ্রেপ্তার না হয়, সেটি দেখা সকলের দায়িত্ব। তবে মামলাটি নতুন করে তদন্ত হবে কি না তা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।’

তিনি জানান, বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা যেন নিরাপদে বসবাস করতে পারেন, এ জন্য প্রশাসন সহযোগিতা করছে। এ নিয়ে সমঝোতার জন্য গ্রামবৈঠকও হয়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *