গরম থেকে বাঁচতে বাঙালির যত কৌশলবিদ্যা

টাইমস রম্য
4 Min Read
এ গরম থেকে বাঁচার যত সহজ উপায়। গ্রাফিক্স: টাইমস

‘বৈশাখ শেষ হইয়া আসে, কিন্তু মেঘের ছায়াটুকু কোথাও নাই, অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে যেন আগুন ঝরিয়া পড়িতেছে।

সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার মত তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা ঝিমঝিম করে-যেন নেশা লাগে।’

‘মহেশ’ গল্পে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাপদাহের যে বর্ণনা দিয়েছেন, বৈশাখের শেষদিকে এসে সেই তাপে আমাদের ব্রহ্মতালু যেন গলে গলে পড়ছে। আরও কতদিন চলবে জানা নেই।

আবহাওয়াবিদরা হয়ত অনেক কিছু বলবেন। শীতলতার ইঙ্গিত দিয়ে একটু আধটু বৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও জানাবেন। কিন্তু এটা কবি শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত কবিতার মতোই: ‘সরকারি প্রেসনোটের মতো মিথ্যা তোমার প্রেম।’

কবি গোলাম মোস্তফা ‘বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম’ বলে নুরু-পুশি-আয়েশা-শফির যে আনন্দের চিত্র এঁকেছেন, সেই কাল গত হয়েছে অনেক আগে। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, অন্যদিকে শিল্পায়ন আর ঘরবন্দি এসির ঠাণ্ডা নিশ্চিত করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই ধরিত্রীকে নরকে পরিণত করেছি।

দেশে যে মৃদু তাপপ্রবাহ চলছে তাতে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত।

তাই বলে হতাশ হয়ে পড়লে ত চলবে না।  এই আগুন গরমে যখন শরীর-মন দুইই রোদে সিদ্ধ, তখন বাঁচার জন্য আমাদের উদ্ভাবনী শক্তিই একমাত্র ভরসা। একেকজন একেক রকম পন্থা খোঁজে—কারও কাছে রিকশার ছায়াই স্বর্গ, কেউ আবার শপিং মলের এসিতেই খুঁজে ফেরেন আত্মা ঠাণ্ডার পথ।

সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট বলে কথা।

কেউ সোজা ঢুকে পড়ে শপিং মলে, হাতে একখানা ব্যাগ, মুখে চিন্তিত ব্যবসায়ী লুক। এজন্য বহুতল শপিং মল হলে সবচেয়ে ভালো। মলের এসিতে আত্মার শান্তি, শরীরে চিনি বেশি থাকলে ফ্লোরের পর ফ্লোর হেঁটে তারও একটা গতি।

এটিএম বুথগুলোর দিকে তাকালে এখন আর টাকার কথা প্রথমে মনে পড়ে না। বরং সেটা যেন একেকটা খুদে আইসল্যান্ড! ঢুকেই মনে হয়, ‘ভেতরে ২৪ ডিগ্রি, বাইরে ৪৪—হায় খোদা!’ কার্ড ঢুকিয়ে, কিছু না তুলেই দাঁড়িয়ে থাকা একধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলন। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেই হয় নিজেকে, ‘আমি কি টাকা তুলতে এসেছি, না ঠাণ্ডা  হাওয়ায় আত্মশুদ্ধি করতে?’

বেকারদের জন্য স্পেশাল সুবিধা আছে। বন্ধুর অফিসে হঠাৎ ‘চা খেতে’ ঢুকে গেলে কেউ বের করে দেয় না। চেয়ার পেয়ে গেলে সেটা প্রায় হেলথ রিসোর্ট। বলাই বাহুল্য, শীতল বাতাসে কথা কিছুটা বেশি বলা যায়—‘এই দেশে কিছুই হচ্ছে না ভাই, গরমটা দেখো!’

এমন গরমে রাজনীতি নিয়েও গরম গরম কিছু কথা বলে ফেলা সম্ভব। সেই ‘মহেশ’ গল্পের প্রথম কয়েক বাক্যের মতো: ‘গ্রামের নাম কাশীপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু, দাপটে তাঁর প্রজারা টু শব্দটি করিতে পারে না-এমনই প্রতাপ।’

পকেটে যৎকিঞ্চিত টাকা থাকলে বুকে কিছুটা সাহস নিয়ে ঢুকে পড়া যায় রেস্টুরেন্টে। অল্প কিছু টাকায় কিছু খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়। তবে একসময় গলাধাক্কা না খেতে হয় সেজন্য ঢুকেই সব সাহস খরচ করে ফেলা যাবে না। বের করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত বুকপকেটে কিছুটা সাহস ধরে রাখতে হবে।

শপিং মল, এটিএম বুথ কিংবা রেস্টুরেন্টের বাইরে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাও আছে। হতে পারে রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা বলধা বা বোটানিক্যাল গার্ডেন।

পার্কে গিয়ে বসে থাকতে পারেন, গাছের নিচে বেণী বাঁধা বাতাসের সঙ্গে। সমস্যা একটাই—যদি কোনো চেনা মানুষ দেখে ফেলে, তাহলে জিজ্ঞেস করে ফেলতে পারে: ‘এই বয়সে প্রেম?’ আর ফেরিওয়ালারা তো আছেই।

গরমের মধ্যে এই সমস্ত কৌশলই একেকটা সাহসী কর্মকাণ্ড। আমাদের মতো দেশপ্রেমিক জনগণ গরমে যখন নিজের ঘর ছেড়ে পাবলিক এসিতে ভরসা রাখে, তখন বুঝতে হয়—জীবন মানেই যুদ্ধ। আর এসির নিচে বসে টিকে থাকা মানেই জয়।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *