‘আমি গুলি খেয়ে মরলে জান্নাতে যাব’-মাকে বলেছিলেন নাঈম

টাইমস রিপোর্ট
5 Min Read
শহীদ মো. আক্তারুজ্জামান নাঈম।ছবি : বাসস

মা, আগে মরাই তো ভালো। যে আগে মরে, সে জান্নাতি। গুলি খেয়ে মরলে তো জান্নাতে যাব।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়ার আগে এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে মো. আক্তারুজ্জামান নাঈমের (৪৩) শেষ কথা।

ছেলের পুত্রের শেষ কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা নাজনিন নাহার মিনু (৫৬)। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালে আমি নাঈমকে ফোন করে বলেছিলাম, বাবা, কোথাও যাবা না। ঢাকায় অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, সাবধানে থাকবা।’

নাঈম জবাবে আমাকে বলল, ‘মা আগে মরাই তো ভালো। যে আগে মরে সে জান্নাতি। গুলি খেয়ে মরলে জান্নাতে যাব। আর মা আপনি ছোট ভাইদের আন্দোলনে যেতে নিষেধ করবেন। ওদের নিয়ে আমার চিন্তা হয়।’ এই কথা বলে আমাকে বুঝালেও নাঈম ঠিকই আন্দোলনে গিয়েছে।

নাজনিন আরও বলেন, ফোনে নাঈম বলেন, ‘মা আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি আন্দোলন নিয়ে একদমই টেনশন করবেন না মা। আমি পরে কথা বলব। আমি এখন ব্যস্ত আছি।’এই ছিল আমার বড় ছেলের সাথে জীবনের শেষ কথা।

ঘটনার বর্ণনা
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ধুলিয়া ইউনিয়নের ঘুরচাকাঠী গ্রামের মরহুম আবদুর রব মাস্টার ও নাজনিন নাহারের বড় ছেলে নাঈম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে রাজধানী ঢাকার মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

তার ছোট ভাই আসাদুল ইসলাম আসাদ (২৮) জানান, ‘২৭ জুলাই সন্ধ্যায় খবর পাই আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার মাথায় গুলি লেগে তিনি স্পটেই মারা যান।’ পরে ঢাকা মেডিকেল থেকে তার লাশ উদ্ধার কর হয়।

আসাদ বলেন, ‘তার মৃত্যুর দুদিন পর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তে দেরি হওয়ায় আমরা ২৯ জুলাই তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি। ঢাকায় ও গ্রামের বাড়িতে তার জানাজা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের জানাজা আমি নিজেই পড়িয়েছি। বন্ধু, আত্মীয়স্বজনসহ অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা যে-ই হোক- পুলিশ কিংবা রাজনৈতিক দলের সদস্য, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’

পরিবারের দাবি
শহীদ নাঈমের ছোট ভাই আসাদ বলেন, ‘আমরা দুই ভাই আছি। সরকার যেন আমাদের একজনকে সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমাদের মা বাকি জীবনটা অর্থনৈতিকভাবে ভালো কাটাতে পারবেন। এছাড়া আমাদের ঘর নেই, সরকার যদি থাকার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।’

আর্থিক সহায়তা ও বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা
শহীদ নাঈমের মা জানান, ‘আমার ছেলে শহীদ হওয়ার পর সবার আগে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা আমাকে ৫০ হাজার টাকা ও আমার ছেলের স্ত্রীকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শুধু টাকা নয়, জামায়াতের নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি আমাকে দুইবার বাজার-সদাই করে দিয়েছেন, যাতে চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, আলুসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। আমার শোকের সময় তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন, এটা আমি কখনো ভুলব না।’

বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা করেনি। তবে কবর জিয়ারত করতে এসেছিল এবং পরে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।’

এছাড়া ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা এসেছে। এর মধ্যে আমার হাতে এক লাখ ও আমার ছেলের স্ত্রীকে ৪ লাখ টাকা দিয়েছে।

স্ত্রীর আহাজারি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
শহীদ নাঈমের স্ত্রী রুমা বেগম (৩০) বলেন, ‘আমার একমাত্র সন্তান নাবিলের বয়স ৭ বছর। আমি তাকে নিয়ে কীভাবে বাকি জীবন চলব? এই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি।

রুমা বেগম বলেন, স্বামীর সঙ্গে আমার ১৩ বছরের সংসার ছিল। সরকারের কাছে আমার একটাই অনুরোধ অন্তত আমার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য যেন আমাকে একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়।’

কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী যদি অসুস্থ হতো, তাহলে হয়তো তাকে দেখে কিছুটা মানসিক শান্তি পেতাম। কিন্তু তিনি তো আর নেই! এই শূন্যতা আমাকে ধুঁকে ধুঁকে মারছে। অন্তত আমার ছেলের জন্য হলেও আমাকে একটা চাকরি দেওয়া হোক।’

বিচারের দাবি ও সরকারের প্রতি আহ্বান
শহীদ নাঈমের মা বলেন, ‘আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। কঠিন বিচার হোক। খুনিদের ফাঁসি চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেরা যেন কর্মসংস্থান পায়, সরকারের কাছে এই আবেদন জানাই। কর্মসংস্থান হলে তারা আমাকে নিয়ে অন্তত ডালভাত খেতে পারবে। আর আমাদের একটা ঘর দরকার। সরকার যেন আমাদের দাবি গুরুত্বসহকারে দেখে।’

শহীদ নাঈমের স্ত্রী রুমা বলেন, ‘যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মা-বউকে এভাবে কাঁদতে না হয়।’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *