জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া গুম-হেনস্তার সঙ্গে জড়িত পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। কেবল কোনো বাহিনীর সদস্য হওয়ার কারণে অপরাধী যেন পার না পেয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেওয়া শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন নাহিদ।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা বলেন, ‘এটা তো রাজনৈতিক দিক যে শেখ হাসিনাকে আমরা বিচারের আওতায় আনছি, আওয়ামী লীগের নেতাদের আনছি। একইভাবে পুলিশ, মিলিটারিসহ অন্যান্য বাহিনীর যারা এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ গুমের ঘটনায় যুক্ত তাদেরকেও যাতে বিচারের আওতায় আনা হয়। কোনো বাহিনীর সদস্য বলে যেন কেউ পার পেয়ে না যায় সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে।’
এসময় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন নাহিদ। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি গুমের ঘটনায় অনেক অভিযোগ এসেছে। আমি নিজে অভিযোগ দিয়েছি ডিজিএফআই-এর যে অফিসাররা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে, হেনস্থা করেছে তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অফিসার র্যাবে যারা ছিল, ডিজিএফআইয়ে যারা ছিল, যারা নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। আপনারা রামপুরা বাড্ডার ঘটনায় দেখেছেন বিজিবির একজন আর্মি অফিসারকে। এদেরকে কিন্তু এখনো গেপ্তার করা হচ্ছে না।’
ট্রাইব্যুনাল, আদালত এবং সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘আমাদের আবেদন থাকবে যে অপরাধীকে যেন বিচারের আওতায় নেওয়া হয়। সে কোন বাহিনীর সেটা যেন দেখা না হয়। যারাই জনগণের ওপর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, গুম করেছে, নির্যাতন করেছে সরকারকে ফ্যাসিবাদী হতে সহায়তা করেছে, ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেছে তাদের সকলকেই দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
নাহিদ ইসলাম জানান, মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে তিনি মূলত ২০২৪ সালের ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের ঘটনা পরিক্রমা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন।
সেখানে কী কী বর্ণনা করেছেন জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, ‘গায়েবানা জানাজা থেকে কফিন মিছিলে হামলা করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে জোর করে বের করে দেওয়া এবং পরবর্তীতে ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউনে সারাদেশের ছাত্রজনতাকে নেমে আসার যে আহ্বান এবং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে ডিজিএফআই আমাদেরকে চাপ প্রয়োগ করেছে, পুলিশের ভূমিকা, ছাত্রলীগের ভূমিকা, অন্যান্য বাহিনীর ভূমিকা, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, তাদের ভূমিকা; এই বিষয়গুলো এসেছে। যেটা আমরা দেখেছি আন্দোলনের সময় সেই ঘটনাগুলোই আমি বলেছি।‘
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ পথে নেমে আসার পর পুলিশ সেসময় নির্বিচারে গুলি চালায় অভিযোগ করে নাহিদ বলেন, ‘১৮ ও ১৯ জুলাই পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরাও যোগ দেয়। সেই গুলিতে প্রচুর ছাত্র জনতা সেই সময় শহীদ হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনাগুলো আমরা বলেছি।’
আন্দোলনের সময় বিচার বিভাগের ওপর কেন আস্থা হারিয়েছিলেন তা জানতে চান এক সাংবাদিক।
জবাবে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ক।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার যে একটি ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরাচারী সরকার এবং তিন তিন বার নির্বাচনে তারা ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে যে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করছে সেটা তো আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে যে তারা দলীয়করণ করেছে এবং নিজেদের দলীয় স্বার্থে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ব্যবহার করছে এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল।’
‘ফলে আমি বলেছি যে ১৮ সালেই আমার সেই সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল। কোটা সংস্কার বা বাতিল কোনোটাই শেখ হাসিনা বা সরকার চায়নি। সেই সময়ে আন্দোলনের চাপের মুখে সরকার ঘোষণা দিয়েছিল এবং তার পরিকল্পনা ছিল সুযোগ পাওয়া মাত্র সেটা ফিরিয়ে আনবে। সেটাই আমরা দেখেছি ২০২৪ সালে নির্বাচনের পরে। ফলে আমাদের কাছে এটা কোর্টের বিষয় ছিল না, এটা ছিল রাজনৈতিক বিষয়।
এসব কারণে শুরু থেকেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট ছিল যে, দাবি আদায়ে রাজপথে অবস্থান দৃঢ় রাখতে হবে।
নাহিদ আরো বলেন, ‘এ কারণে আমাদের আদালতের প্রতি কোনো আস্থা ছিল না। আমরা আদালতে যাইনি। আমরা আদালতের বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করিনি। আমরা বলেছি এটা নির্বাহী বিভাগের বিষয়।’
ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা তা জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যাশা করি ন্যায়বিচার। এত মানুষ, এত ভাইবোনেরা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন। আমরা সকলে ন্যায় বিচার পাবো এবং যারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ পুলিশসহ যারা জড়িত তকারা বিচিারের আওতায় আসবে। তাদের শাস্তি হবে এবং এই ন্যায়বিচার একটা নিদর্শন হয়ে থাকবে শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর জন্য। যদি কেউ স্বৈরশাসন কায়েম করতে চায়, জনগণের ওপর আক্রমণ চালায় তার পরিণতি আসলে কী হবে।’
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।