রাজপথ থেকে আদালত সবখানে অনিরাপদ সাংবাদিক

মো. আল আমিন সাদমান
4 Min Read
প্রতীকী ছবি

রাজপথ থেকে আদালত, কোথাও আর সাংবাদিকরা নিরাপদ নন। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা আর রাজনৈতিক চাপ দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সাংবাদিকদের ওপর নানা ধরনের দমন-পীড়নের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যে জানা যায়, শুধু ২০২৫ সালের আগস্ট মাসেই ৩৯টি ঘটনায় ৭২ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে। এর মধ্যে একজন নিহত, ৩৩ জন আহত, একজন গ্রেপ্তার এবং ১৯ জন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন।

গত ৭ আগস্ট গাজীপুরে নির্মমভাবে খুন হন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। এক নারীকে মারধরের ভিডিও করতে গিয়ে তিনি সশস্ত্র যুবকদের হাতে আক্রান্ত হন। তারা তাকে তাড়া করে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই দৃশ্য ভিডিও আকারে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়।

এর কয়েকদিন পর, ঢাকার আদালতে ঘটে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা। গত বৃহস্পতিবার জামিন শুনানি প্রতিবেদন করতে গিয়ে সময় টিভির সাংবাদিক আসিফ মুহাম্মদ সিয়াম আইনজীবীদের হামলার শিকার হন। সাংবাদিক মুকতাদির রশীদ রোমিও আসামি মনজুরুল আলম পান্নাকে (যিনি নিজেও সাংবাদিক এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক) একটি প্রশ্ন করলে আইনজীবী মুহিউদ্দিন উত্তেজিত হয়ে রোমিওকে গালাগাল করেন।

পরে মুকতাদিরকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসা সিয়ামের ওপর চড়াও হন। সিয়ামকে টেনে আদালতকক্ষ থেকে বাইরে এনে মারধর করা হয়। তিনি গুরুতর আহত হন। শেষ পর্যন্ত আরেকজন আইনজীবী হস্তক্ষেপ করে তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন।

এই ঘটনায় সবার মনে প্রশ্ন উঠেছে, যদি আদালতের ভেতরেও সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হন, তবে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই গণমাধ্যমকে রাজনীতির বাইরে কল্পনা করা যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘মিডিয়া সিস্টেম রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনুসারী। একে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। এই রাজনৈতিক জটিলতা থেকে ভয় আর সহিংসতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত এক বছরে ভয়ের মাত্রা অন্তত ৩০ গুণ বেড়েছে। অনলাইনে এবং অফলাইন দুই জায়গাতেই দুই জায়গাতেই হুমকির মুখে মবের হুমকির মধ্যে থাকতে হয়।’

সরকারের সাংবাদিক সুরক্ষা আইন কার্যকর না করার সমালোচনাও করেন তিনি।

তার মতে, যতদিন রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন না হবে, ততদিন কোনো আইন কার্যকর হবে না। শত আইন পাস করলেও কাজ হবে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর তথ্যও ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং তিনজন খুন হয়েছেন।

টিআইবি জানায়, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ‘পরোক্ষ ও সুসংগঠিতভাবে’ সীমিত করা হয়েছে, এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও।

সাংবাদিক সুরক্ষা আইন জরুরি

২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর সরকার ১১ সদস্যের একটি মিডিয়া সংস্কার কমিশন গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সততা ও নিরপেক্ষতা জোরদার করার প্রস্তাব দেওয়া।

সাংবাদিক কামাল আহমদের নেতৃত্বে কমিশনটি  এ বছরের ২২ মার্চে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

কিন্তু এর পর থেকে পুরো প্রক্রিয়া থেমে গেছে। সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে কামাল আহমদ এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, যদি প্রস্তাবিত সাংবাদিক সুরক্ষা আইন ইতোমধ্যেই কার্যকর হতো, তবে অনেক ঘটনা রোধ করা যেত।

তিনি বলেন, ‘আমরা যে আইন প্রস্তাব করেছিলাম, সেটি এখন কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সবকিছু আটকে আছে।’

তিনি আইনটি অবিলম্বে অধ্যাদেশ আকারে পাস করার দাবিতে জনগণকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *