ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তৈরি হয়েছে এক উৎসবের আমেজ। নির্বাচন ঘিরে তাই শিক্ষার্থীদের মাঝেও স্পষ্ট সেই উচ্ছ্বাস। তবে, এবারের প্রচারণায় আলাদা করে নজর কাড়ছে লানজু খানের কণ্ঠে, সিফাতের লেখা এক ভিন্নধর্মী গান। গানটি তাই ডাকসু প্রচারণার সীমা ছাড়িয়ে প্রতিফলিত করছে শিক্ষার্থীদের ঐক্য, সংগ্রাম, আশা ও সাংস্কৃতিক চেতনা।
গানের শুরুতেই ‘আইলো রে ডাকসু’ ধ্বনির পুনরাবৃত্তি যেন ঢাবি ক্যাম্পাসে এক ধরনের আনন্দঘন আবহ তৈরি করেছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, ডাকসু নির্বাচনকে শিক্ষার্থীরা শুধু রাজনৈতিক আয়োজন হিসেবে নয়, বরং গ্রহণ করছে উৎসবের মতো করেই। গানটিতে উঠে এসেছে, বিভাজনমুক্ত ডাকসু, যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসার প্রত্যাশা এবং শিক্ষার্থীদের মতামতের গুরুত্বের মতো বিষয়। অর্থাৎ, শুধু নির্বাচন হওয়াই যে যথেষ্ট নয়, সেটি যে হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য, সেই প্রত্যাশাই প্রতিফলিত হয়েছে গানটির প্রতিটি লাইনে।
গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন লানজু খান। তিনি দ্য টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডাকসু আমাদের জন্য একটি উৎসবের মতো। আমার মনে হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নিয়ে যে উদ্দীপনা আছে, তা ত্বরান্বিত করতে সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটা ছোঁয়া থাকা দরকার।’

হঠাৎ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে গান করার ভাবনা কীভাবে এলো, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি যেহেতু গানের মানুষ, তাই গানকেই বেছে নিয়েছি।’
তার কণ্ঠে এই উদ্যোগ যেন নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, ডাকসু কেবল নির্বাচনী রাজনীতির পরিমণ্ডল নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক চেতনারও প্রতীক।
গানটিকে আলাদা করে তুলেছে এর ভেতরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক রেফারেন্স, সমসাময়িক সমস্যার প্রতিফলন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এখানে, সূর্যসেন, মুজিব, জসীমউদ্দিন, জহুরুল হক, শামসুন্নাহার, বঙ্গমাতা, রোকেয়া কিংবা সুফিয়া কামাল হলের উল্লেখ কেবল নাম নয়, বরং ঢাবির ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, সংগ্রাম আর নারী অংশগ্রহণের প্রতীক।
লানজু বললেন, ‘গানটা কিন্তু লেখা সিফাতের। ও আমার ছোট ভাই। ওর চিন্তাধারা, আমার চিন্তাধারা এবং গানের সাথে যুক্ত সবার ভাবনা এক জায়গাতেই মিলে গেছে। সমতা, একতা আর ইতিবাচক মনোভাব।’
গানে এসেছে শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যাগুলোও। র্যাগিং, ট্যাগিং, গণরুম, আবাসন সংকট কিংবা নিয়মনীতি ভঙ্গের মতো বিষয়গুলো কেবল অভিযোগ নয়, বরং পরিবর্তনের অঙ্গীকার হিসেবেই ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে ব্যালট পেপারকে ক্ষমতার প্রতীক করে তোলা হয়েছে।
‘ব্যালট পেপার তাদের হাতে, ভোটটা তাদের ক্ষমতা।’ এই অংশটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেখায় যে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারকে কেবল দাবি নয়, বরং বাস্তব পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করতে চায়।
গানটির প্রযোজনার দিকটিও ভিন্ন। শুধু গায়ক বা বাদক নন, আয়োজকরাও প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর ফলে গানটি হয়ে উঠেছে ঢাবির তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতার প্রতীক। আর সুরে এসেছে এক র্যাপের আধুনিক ছোঁয়ার সাথে ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগানের ঐতিহ্যবাহী ধারার এক অনন্য মিশ্রণ।
গানটির লেখক সিফাত দ্য টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেকেই গানটিকে “ডাকসুর একটি থিম সং” হিসেবে বিবেচনা করছেন, যা আমার কাছে সত্যিই অত্যন্ত আনন্দের।’
তার মতে, সংস্কৃতি সবসময়ই রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। এ দেশের ভাষা আন্দোলনের গান, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা কিংবা ২০২৪ সালের আন্দোলনের সঙ্গীত তারই প্রমাণ। তিনি বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যতেও এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এদিকে লানজুর পরিকল্পনা কেবল গানেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে অদৃশ্য দেয়ালটি ভেঙে ফেলতে। ক্যাম্পাসের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি করতে চান ম্যাগাজিন, আয়োজন করতে চান নাটক, চিত্রকলা, মুকাভিনয়, নৃত্য ও চলচ্চিত্রসহ নানা শিল্পচর্চার প্ল্যাটফর্ম। এছাড়াও, ভবিষ্যতের রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সহাবস্থান নিশ্চিত করার আশাও ব্যাক্ত করেন তিনি। এ যেন এক নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা, যেখানে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যও হয়ে উঠবে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
গানটির প্রিয় লাইন তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আগুন শেষে ফাগুন আইলো, জাগলো যখন জনতা। স্বৈরাচারের বিদায় কারণ শিক্ষার্থীর একতা। এখানে “আগুন” দ্বারা বোঝানো হয়েছে স্বৈরাচারের দমন-পীড়ন ও নির্যাতন, আর তারই প্রতিফলন হিসেবে এসেছে “ফাগুন” এক নতুন সূচনা। অর্থাৎ, জুলাই আন্দোলনের বিজয়। আর এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শিক্ষার্থীদের একতার শক্তিতে। তাই, এই দুটি লাইন তার কাছে বিশেষভাবে প্রিয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মনে ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগায় “আইলো রে, আইলো রে, ডাকসু আইলো রে! নতুন ভোরে রঙিন সুরে খুশির জোয়ার আইলো রে!”
সব মিলিয়ে এই গান কেবল প্রচারণার অংশ নয়, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক চেতনা, ঐক্য ও সংগ্রামের প্রতিফলন হয়ে উঠেছে। ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে এই গান তাই তরুণ প্রজন্মকে ভোটের রাজনীতির বাইরে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত হতে উৎসাহিত করবে এমনটাই আশা। ফলে, লানজু খানের এই উদ্যোগ এবারের ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন হয়ে থাকবে।