মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ার—কিন্তু অবিশ্বাস্য রকম সাফল্য। ২৭টি ছবির মধ্যে প্রায় অধিকাংশই ব্যবসাসফল। ছবিগুলোতে তার অভিনয় আজও দর্শককে হাসায়, কাঁদায় কিংবা ভাবায়। অনেক বড় সমালোচকও বলে আহা কতটা ‘প্রাণবন্ত’ ছিল তার অভিনয়।
‘বিক্ষোভ’-এ বিদ্রোহী তরুণ, ‘কন্যাদান’-এ দায়িত্ববান পুরুষ, ‘এই ঘর এই সংসার’ এবং ‘জীবন সংসারে’ মধ্যবিত্ত জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রাম, প্রেম ও দ্বন্দ্বের জটিলতাকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রাঞ্জলভাবে ফুটিয়েছেন। তার অন্যবদয় অভিনয় চরিত্রগুলোকে হৃদয়স্পর্শী ও জীবন্ত করে তুলেছিল। কিংবা ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’-এ তার অভিনয় কাঁদায়নি এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চরিত্রের এতটা গভীরে বাণিজ্যিক ছবির কয়জন নায়কই বা যতে পেরেছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এই অতুলনীয় নায়ক জীবদ্দশায় একবারও পাননি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রশ্ন জাগে—কেনো এমন হলো?
ওই সময়ে ইলিয়াস কাঞ্চন, আলমগীর বা রুবেলের মতো অভিনেতারা মানবিক বা সামাজিক সমস্যানির্ভর ছবিতে কাজ করছিলেন। জুরি বোর্ডের চোখে এসব ছবিই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তুলনায় সালমান শাহর ছবিকে কেবল ‘তারুণ্যের উচ্ছ্বাস’ হিসেবেই দেখা হতো। ফলে প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি। এমন অভিমত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক ছটকু আহমেদের। তিনি বলেন, ‘সালমান শাহ অভিনেতা হিসেবে একশতে একশ ছিল। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে যে ধরণের ছবিকে বা চরিত্রকে পুরস্কার দেওয়া হত, তা সে খুব একটা করেনি। তার বেশিরভাগ চরিত্রই রোমান্টিক কিংবা প্রতিবাদী তরুণের ছিল। সেগুলোতে সে অসাধারণ অভিনয় করলেও জুরি বোর্ড হয়তো তা বিবেচনায় নেয়নি।’
আরেক নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের মতে, “শুধু ‘আনন্দ অশ্রু’ কিংবা ‘বিক্ষোভ’ না শুধু আমি মনে করি ‘মায়ের অধিকার’-এও সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার ছিল। কিন্তু তখন হয়তো প্রতিযোগীতা অনেক বেশি ছিল। তাই তিনি পাননি। তবে আমার বিশ্বাস উনি যদি আরও ২-৩ বছর বেঁচে থাকতেন তাহলে পুরস্কার পেতেন।”
মানিক যোগ করেন, ‘সালমান শাহ পুরস্কারের জন্য কোনো প্রকার লবিং, রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটানো কিংবা নিজে লালায়িত ছিলেন না। তিনি জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন তাই হয়তো জনপ্রিয় ধারার ছবি বেশি করেছেন।’
সালমান শাহর ‘জীবন সংসার’ পরিচালক জাকির হোসেন এ বিষয়ে শুধু আফসোস করে বলেন, ‘তার পুরস্কার পাওয়া দরকার ছিল, কিন্তু কেন পায়নি এ নিয়ে আপাতত মন্তব্য করবো না।’
চলচ্চিত্র সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান জানান, সালমান যখন মারা যান তখন আজকের মত তরুণ নায়কদের ভাগ্যে এত সহজে শিঁকে ছিঁড়ত না। সমসাময়িক সময়ে জাফর ইকবালও পুরস্কার না পেয়ে মারা যান। এমনকি জসীমও পুরস্কার না পেয়ে মারা গিয়েছিলেন। সোহেল রানা সালমান মারা যাওয়ার বছরই দুদশক ক্যারিয়ার সম্পন্ন করার পর প্রথমবার পুরস্কার পান। তার জীবদ্দশায় রাইসুল ইসলাম আসাদ একবার, আরেকবার আলমগীর পুরস্কার পান। তার মৃত্যুর পর রাইসুল ইসলাম আসাদ পেয়েছেন আরেকবার।
তিনি বলেন, ‘ক্যারিয়ারের চার বছরে তিনি কোনো কাজ দিয়েই পুরস্কার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেননি। যারা ওই বছরগুলোতে পুরস্কার পেয়েছেন তারা নি:সন্দেহে যোগ্য অভিনেতা। আসলে তখন ঘুরে-ফিরে তারাই পুরস্কার পেতেন। জুরিরা তাদের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল ছিলেন। ফলে সালমান শাহ কিছু ছবিতে খুব ভাল কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কার তার অধরাই থেকে গেছে।’
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া নিয়ে সালমান শাহ তার জীবদ্দশায় একবার ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন। যদিও একান্ত আড্ডায় তিনি নায়ক আলমগীরকে নিয়ে এ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তখনকার বিখ্যাত এক সাপ্তাহিকে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। ফলশ্রুতিতে তিনি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েন। এ ঘটনায় তার ভক্ত-অনুরাগীরা মনে করে সালমান শাহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পাওয়ার পিছনে ‘ফিল্ম পলিটিক্স’ও ছিল।
তবে সময় প্রমাণ করে দিয়েছে, পুরস্কারই শেষ কথা নয়। সালমান শাহ আজও আছেন কোটি দর্শকের মনে। তার জন্মদিনে বা মৃত্যুবার্ষিকীতে ভক্তদের যে আবেগ দেখা যায়, তা কোনো পদক দিয়ে মাপা যায় না। এক দর্শক একবার বলেছিলেন, ‘জাতীয় পুরস্কার পেলো কি পেলো না, তাতে কী এসে যায়। সালমান শাহ তো আমাদের হৃদয়ে অমর নায়ক হয়ে আছেন।’