পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে সরকার প্রতি বছর বিপুল্ অংকের টাকা অনুদান দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রতি বছরই এ নিয়ে নানান অভিযোগ উঠে চলচ্চিত্র সংগঠন ও নির্মাতা-প্রযোজকদের তরফ থেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘চলচ্চিত্র অনুদানে স্বচ্ছতা’ শীর্ষক এক মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে জাতীয় চলচ্চিত্র আন্দোলন। সেখানেই এসেছে ৭টি প্রস্তাবনা।
রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে রোববার আয়োজিত আলোচনায় জাতীয় চলচ্চিত্র আন্দোলনের সংগঠক মোহাম্মদ নূরউল্লাহ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি অনুদান প্রতিক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য ৭টি প্রস্তাবনা দেন।
প্রস্তাবনার রয়েছে—আবেদনকারীর নাম, কাহিনি সংক্ষেপ অনলাইনে বিস্তারিত প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা। আবেদনকারীর আবেদন কোন পর্যায়ে রয়েছে তা যেন ট্র্যাক করা যায় তার ব্যবস্থা রাখা। পরিচয় গোপন রেখে বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের দিয়ে আবেদনগুলো মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করা এবং এ মূল্যায়ন ও এর ফলাফল অনলাইনে লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে অ্যাপ ডেভলপ করে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়ার কথাও প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।
জুরিদের ব্যাপারে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আবেদনের মান যাচাইয়ের জন্য তাদের জন্য গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া। এতে করে জুরির ব্যক্তিগত পছন্দ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
এবার অনুদানের ক্ষেত্রে সরকারী বিভিন্ন কমিটিতে থেকে অনুদান নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটি প্রতিরোধে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এটি আইন করে ঠেকানো কঠিন। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির সততা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হোক। অনুদানে আবেদনের বিষয়বস্তু নির্ধারিত থাকলেও কারা অনুদান পাবে তা নির্ধারিত নয়। এ ব্যাপারটিও সুনির্দিষ্ট হওয়া জরুরি।
সবশেষ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, জুরি সদস্যদের আর্থিক ও অন্যান্য মূল্যায়ন যথাযথভাবে করা জরুরি এবং তাদের যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় তাও জরুরি।
মোহাম্মদ নূরউল্লাহ তার প্রবন্ধের শুরুতে এবারের অনুদানের বেশকিছু সমালোচনা করেন। এর মধ্যে তিনি পিচিংয়ের জন্য ৯৫টি সিনেমা নির্বাচনের বিষয়টিও উল্লেখ করেন । তিনি প্রশ্ন রাখেন কীভাবে ৯৫টি সিনেমার জন্য মাত্র ১২ ঘণ্টায় পিচিং করা যায়? এছাড়া তিনি অনুদানের ছবি বাছাইয়ের উপায়, নিজেরা নিজেদের অনুদান দেওয়া, ঠিকঠাক মূল্যায়ন, সরকার তার পছন্দের লোককে অনুদান দেওয়া, অনুদানে কোন বৈষম্য হয়েছে কিনা, অনুদান কমিটির সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়গুলো নিয়ে প্রবন্ধে কথা বলেন।

অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমানের সভাপতিত্ব ও উপস্থাপয়নায় আলোচনা সভাতে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র গবেষক বিধান রিবেরু, অনুদান কমিটির সদস্য আকরাম খান, পার্থিব রাশেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী, মোহাম্মদ কাইয়ুম। এছাড়াও বাচসাস সভাপতি কামরুল আহসান হাসান দর্পণ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রতিনিধি রুবেল ইউনুস । উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ, বাংলাদেশ টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (তেজাব), চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ ২৪, বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও নাগরিক ঐক্যের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা।
মোহাম্মদ কাইয়ুম বলেন, ‘অনুদানের জন্য পূর্ণ স্ক্রিপ্ট দেয়া জরুরি নয়। নির্মাতার ফিল্মগ্রাফি, লগ লাইন, সিনোপসিস স্টোরি লাইন বা ট্রিটমেন্ট এগুলো দিয়েই পৃথিবীর অন্যত্র চলচ্চিত্রে অনুদান দেয়া হয়।’
নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের সিনেমাকে কেউ ধারণ করে না। চলচ্চিত্রের অনুদান পাবার পর নির্মাতারা ভোগান্তি আরো বেশি যেটা নিয়ে আলোচনা হয় না, যেটাও সমান ভাবে জরুরি। রাজনৈতিক প্রভাব এড়িয়ে আবেদনের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার জরুরি।’
চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ ২৪ এর প্রতিনিধি সাজেদুল বলেন, ‘সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির আবেদনের বিধান নীতিমালায় থাকলেও কেউ এখনো সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেনি।’
আকরাম খান বলেন, ‘অনুদানের সংখ্যা বাড়ানো উচিত এবং বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশে প্রামাণ্যচিত্রকে চলচ্চিত্র মনে করা হয় না। ফিকশনের সাথে একি সাথে সমান্তরালে সব ক্যাটাগরিতে প্রামাণ্যচিত্রেও অনুদান দেয়া উচিত।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক মোহাম্মদ নূরউল্লাহ পরবর্তীতে তার বক্তব্যে বলেন, ‘চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা নিজেদের মধ্যে চাওয়াগুলো আলোচনা করে ঠিক করে নিতে পারলে, সবাই মিলে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া করতে পারলে সরকারের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়, এজন্যই ঐক্যমতে পৌঁছাতে আরো আয়োজন আরো করা হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে এডভোকেট শফিকুর রহমান বলেন, ‘জাতির মানস গঠনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। সেখানে ফিল্ম মেকারদের পথ দেখানোর কথা । আমাদের চলচ্চিত্র সেই পথ কী দেখাচ্ছে? আমাদের নির্মাতারা নৈতিক জায়গা থেকে নেতৃত্ব দিবেন সেটাই প্রত্যাশা।’