ছেলে নতুন পোশাক নিয়ে আসবে- এ অপেক্ষায় ঈদ পার করেছেন শহীদ মারুফের বাবা

টাইমস রিপোর্ট
5 Min Read
শহীদ মারুফ হোসেন, ছবি :বাসস

ছেলের আনা জামা পরেই এবারের ঈদ করবেন- এমন আশায় বসেছিলেন মো. ইদ্রিস। কিন্তু আর কোনো জামা হাতে করে ঘরে ফেরেনি তার বড় ছেলে মারুফ হোসেন। ঈদের দিন কেটেছে এক মিছে অথচ মায়াময় প্রতীক্ষায়। ছেলের অনুপস্থিতিই ছিল এ বছরের সবচাইতে বড় শূন্যতা।

ব্যথাতুর হৃদয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে ছেলে হারানোর বেদনার প্রকাশ করতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন মো. ইদ্রিস।

মো. ইদ্রিস বলেন, আমার ছেলে মারুফ বিগত কয়েক বছর ধরে আমাকে ঈদে নিজে পছন্দ করে পোশাক কিনে দিয়েছে। এবারের ঈদের দিনটি তাই মারুফের অপেক্ষায় কেটে গেছে: কখন আমার ছেলে মারুফ আমার পছন্দের পোশাকটি নিয়ে বাড়ি আসবে।

শহীদ মারুফ হোসেন (১৯)-এর বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাট একতা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন তার ছেলে মারুফ হোসেন।

ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, শহীদ মারুফ হোসেন ভাল ক্রিকেট খেলত। পাশাপাশি জিম করত। একজন ক্রিকেটার হিসেবে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘাতক বাহিনীর প্রাণঘাতী বুলেট সব স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।

গত ১৯ শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে মারুফ ছিলেন সবার বড়। মেঝ ভাই মো. ইমরান হোসেন (১৫)। পড়াশোনা করেন ৯ম শ্রেণিতে। ছোট ভাই মো. জোনায়েত হোসেন (১০)। পড়াশোনা করেন ৪র্থ শ্রেণিতে।

শহীদ মারুফ হোসেন পরিবারের সঙ্গে থাকতেন রাজধানীর বাড্ডায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন। বাবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করেন। বর্তমান ঠিকানা: পূর্ব বাড্ডা, কবরস্থান রোড, হোল্ডিং-১৯৫৮, বাড্ডা, গুলশান মডেল টাউন, ঢাকা।

তিনি বলেন, আমি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করি। সেই কাজে মারুফ আমাকে সহযোগিতা করত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মারুফ শহীদ হওয়ার পর আমার তেমন কোনো কাজ নেই। মুলত মারুফ কাজগুলো ম্যানেজ করে নিয়ে আসত।

সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মো. ইদ্রিস বলেন, সেদিন ছিল ১৯শে জুলাই। দুপুরে আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের তিন সন্তানকে নিয়ে একসঙ্গে খাবার খেয়েছি। রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর থেকেই মারুফ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে বেশি আসা-যাওয়া করত।

ঘটনার দিন সকাল ৮টায় বাসা থেকে বেরিয়ে আবার দুপুরে খেতে এসেছিল। ওর মামা সেদিন একই সঙ্গে ছিল। পৌনে ৬টার দিকে সে কল করে জানায়- মারুফের গায়ে গুলি লেগেছে। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।

খবর শুনে হতভম্ব হয়ে দৌড়ে যাই, রাস্তায় কোনো দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করছিল। এর মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় ছেলেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই।

সেদিন ঘটনাস্থলে একটি অ্যাম্বুলেন্স লাশ বহন করছিল। তখন সেখানে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মারুফকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সটির গতিরোধ করে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই মারুফকে নিতে রাজি হচ্ছিল না।

পরে শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্সটি ভাঙার প্রস্তুতি নেয়। তখন চালক আমার সন্তানকে তার গাড়িতে তোলে। প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলা হয়।

মারুফকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি যখন ইউটার্ন নিয়ে রামপুরা ব্রিজের ওপর যায়, তখন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্সটির পথ রোধ করে। তখন আমার সন্তানের মুখে অক্সিজেন লাগানো ছিল, সে জীবিত ছিল। পানি খেতে চেয়েছিল। তারা আমার সন্তানের যে স্থানে গুলি লেগেছিল সেখানে পুলিশের রাইফেলের বাঁট দিয়ে খুঁচিয়ে দেখেছে গুলিটা কোথায় লেগেছে।

তখন বাধ্য হয়ে একটি রিকশায় করে অনেক কষ্টে ওকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে পৌঁছাই।

কিন্তু জরুরি বিভাগে যেতে না যেতেই আমাকে ডেথ সার্টিফিকেটে সাইন করতে বলে। তখনই দেখলাম আমার সন্তানটি আর নেই।

মারুফ আমার বড় সন্তান ছিল। সেদিন আমার ছেলেকে নিয়ে আসার কথা বললে সেদিন কর্তৃপক্ষ লাশ দিতে রাজি হয়নি।

আমি আমার জীবনে এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি। এক থানা থেকে আরেক থানায় পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য ছুটতে হয়েছে। অনেক যুদ্ধ করে রামপুরা থানা থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আসি।

ঢামেকের মর্গে গিয়ে দেখি লাশ আর লাশ। সেখানে আমার সন্তানের মরদেহ ৩ জনের নিচে পড়ে আছে। পা দেখে আমার সন্তানের লাশ শনাক্ত করি। ৩ টা লাশ দিয়ে দেয়ার পর যখন জানতে পারে মারুফ ছাত্র ছিল তখন আর তার লাশ দেয়নি।

পরের দিন সকালে আবার গিয়ে আমার সন্তানের মরদেহ আর পাই না সেখানে। মর্গের ফ্রিজের মধ্যে ৪ বার গিয়েছি, খুঁজে পাই না। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখি বার্ন ইউনিটের গ্রাউন্ডে তার মরদেহ ফেলে রেখেছে।

তার বডি দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। ৩ দিন পরে মর্গে এনে ময়নাতদন্ত শেষে অর্ধগলিত মরদেহ নিয়ে বাড়িতে আসি। এরপর মৃতদেহ ঢাকার বাড্ডা এলাকায় দাফন করি।

এ সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, আমার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তার রক্তে রাজপথ ভিজেছে। জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যারা গুলি চালিয়ে মানুষকে হত্যা করেছে তাদের বিচার করতে হবে।

শহীদ পরিবারের সদস্যরা আরো জানান, মারুফ হোসেন শহিদ হওয়ার পর বাংলাদেশ জামায়েত ইসলাম’র পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *