
‘১৬ জুলাই দুপুরে খবর পেলাম, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। প্রথমে খবরটা বিশ্বাস করতে পারিনি। বেরোবির সমন্বয়ক হিসেবে আমাদের সঙ্গে আগে থেকেই আবু সাঈদের যোগাযোগ ছিল। এএফপি আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করল। নিশ্চিত হওয়ার পর শহীদ মিনারের জমায়েতে হ্যান্ডমাইকে খবরটা ঘোষণা করা হলো। ছাত্রলীগ চারদিক থেকে ক্যাম্পাস ঘিরে রেখেছিল। আমাদের মাইকও শহীদ মিনারে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কয়েকবার মাইক আনার চেষ্টা করলে হয় ছাত্রলীগ তা ভেঙে দিয়েছে, নয়তো সেটা পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করতে হয়। আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর জানার পর সবাই প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। সবাই মারমুখী হয়ে ছাত্রলীগের ওপর প্রায় হামলা করতে যাচ্ছিল। ছাত্রলীগ ছিল সশস্ত্র। আমরা তাই সেটা থামানোর চেষ্টা করলাম’, জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম শহীদ আবু সাঈদের আত্মদানের কথা এভাবে স্মৃতিচারণায় বলছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক, বর্তমান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ শীর্ষক গ্রন্থে অভ্যুত্থানের দিনলিপি তুলে ধরেছেন সজিব ভূঁইয়া। গত মার্চে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিত বইয়ে ‘শহীদের মিছিল’ পর্বে তিনি তুলে ধরেন উত্তাল দিনগুলোর অনেক অজানা কথা।

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর রাতে আমরা শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে ফুলার রোড দিয়ে মল চত্বরে গিয়ে মিছিল শেষ করি। মিছিলে সবার হাতে স্টাম্প বা লাঠি। হাজার দশেক লোকের সেই মিছিলে স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই স্টাম্প বা লাঠি দিয়ে রাস্তায় আঘাত করছিল। পুরোপুরিই যেন এক যুদ্ধপরিস্থিতি। পরিস্থিতির তীব্রতায় ছাত্রলীগের মনোবল ভেঙে পড়তে শুরু করে। এর মধ্যে আমাদের জমায়েতে উদয়ন ও ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থীদের যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। আমরা রাজু ভাস্কর্যে আছি ভেবে তারা সেখানে যায়। সংখ্যায় তারা ছিল চার-পাঁচ শ। রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে তারা ছাত্রলীগকে মারধর করে আসে। ছাত্রলীগের মনোবল তখন আরও ভেঙে পড়ে। এ খবর আমরা পাই কর্মসূচি শেষ হওয়ার পরে।’
‘আমরা মল চত্বরে গিয়েছিলাম মূলত হলের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে হলে দিয়ে আসার জন্য। অনেকে হলে চলে গেল, অনেকে থেকে যেতে চাইল।’
‘আমরা বিভিন্ন হলের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। বিজ্ঞানের তিনটি হল থেকে আগেই ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়েছিল। বাকিরাও এবার ছাত্রলীগ বিতাড়ন শুরু করল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানালাম, তারা যাতে ছাত্রলীগকে হল থেকে বের করে দেয়। অনেক হল থেকে ছাত্রলীগ অবশ্য এমনিতেই চলে গিয়েছিল। আর পরও আহ্বান চলতে লাগল। সকালের মধ্যেই সব হল ছাত্রলীগমুক্ত করতে হবে,’ বলেন আসিফ মাহমুদ।

তিনি আরো বলেন, ‘ওই রাতেই বিভিন্ন হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য প্রাধ্যক্ষদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা স্বাক্ষর নিতে শুরু করে। শুরুতে এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে। পরে শিবির এতে সম্পৃক্ত হয়। পরদিন সকাল হতে হতে পুরো ক্যাম্পাস ছাত্রলীগমুক্ত হয়ে যায়। তবে স্যার এএফ রহমান হলে সকালেও ছাত্রলীগের কেউ কেউ অবস্থান করছিল। হলপাড়া থেকে সকালে শিক্ষার্থীদের কয়েকটা মিছিল বের হলো। সেখানে হান্নান মাসউদসহ আমাদের কয়েকজন ছিল। মিছিল এফ রহমান হলে গিয়ে অবশিষ্ট ছাত্রলীগকে বের করে দেয়। এফ রহমান হলে তখন জ্বালাও-পোড়াও আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল। একই সময়ে আমরা ভিসি চত্বরে স্লোগান দিচ্ছিলাম।’
‘১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ ছয়জনের নিহত হওয়ার ঘটনা ছাত্রলীগকে হলছাড়া করার পেছনে তাড়িত করেছিল’—একথা জানিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সেদিন রাতে আমাদের শোডাউন, বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলা ইত্যাদি ঘটনার কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে হলছাড়া করে। ছাত্রদের মধ্যে এক অজানা দুঃসাহস এসে ভর করেছিল।’
‘ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করল। ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসে শহীদদের গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু তার আগের দিন থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে হাসনাত আবদুল্লাহর নামে এমন একটা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে সেদিন আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। পুরো আন্দোলনের সময়জুড়েই আওয়ামী লীগ বহুবার এভাবে অপতথ্য ছড়িয়েছে। আমরা বললাম, “শহীদের রক্তের সঙ্গে কোনো বেইমানি চলবে না। কালও কর্মসূচি পালিত হবে।”

‘১৭ জুলাই ভিসি চত্বরে অবস্থানরত অবস্থায় আমরা বুঝে ফেলি, ক্যাম্পাস বন্ধ করার জন্য সিন্ডিকেটের বৈঠক ডাকা হচ্ছে। খবর পেয়ে আমরা রেজিস্ট্রার ভবন ঘেরাও করার জন্য যাই। গিয়ে শুনতে পাই, সিন্ডিকেটের বৈঠক রেজিস্ট্রার ভবনে নয়, উপাচার্যের বাসভবনে হবে। বুঝতে পারছিলাম, ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আন্দোলনের মূল শক্তি হারিয়ে ফেলব।’
‘আন্দোলনটা অসংগঠিত হয়ে যাবে। বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন পরিচালিত হলে ক্ষতিই বেশি হবে, কিন্তু ফলাফল তেমন কিছু আসবে না। ডিজিএফআইয়ের কর্নেল সারোয়ার আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। সিন্ডিকেটের বৈঠক চলাকালে কর্নেল সারোয়ারকে বললাম, “ক্যাম্পাস খোলা রাখুন। তাহলে আমরা ক্যাম্পাসেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখব।” তিনি কোনোভাবেই রাজি হলেন না। প্রথম দফায় সিদ্ধান্ত ছাড়া বৈঠক শেষ হলো। পরের দফায় ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা এল।’
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘১৭ জুলাই সিন্ডিকেটের বৈঠক চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে “বাংলাদেশের জনগণ,/ নেমে আসুন, নেমে পড়ুন” স্লোগান দেওয়া হয়। ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়ার ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ছে, ছাত্রদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমছে। এ অবস্থায় আমরা জনগণকে যুক্ত করতে চাইলাম। ততক্ষণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও মোটামুটি যুক্ত হচ্ছে। তখনকার ভিডিও বার্তাগুলোতে আমরা অভিভাবকদেরও আহ্বান জানাই, “আপনারা আমাদের অভিভাবক, আমাদের বাঁচানোর জন্য আসুন।”…