শেষবারের মতো ‘মা’ ডাকতে পারেনি শহীদ সুলাইমান

বাসস
4 Min Read
শহীদ সুলাইমান। ছবি: বাসস

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনে সেদিন সারা দেশ আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, যোগ দেয় বিজয় মিছিলে।

‘আমার বাবায়ও রক্তে ভেজা সেই আন্দোলনে গিয়েছিল। কিন্তু বিজয় দেখে যেতে পারে নাই। আমায় শোকের সাগরে ভাসিয়ে একা করে চলে গেছে পরপারে।’ অশ্রুসিক্ত চোখে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ সুলাইমানের মা রোকসানা বেগম।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান সুলাইমান।

ছেলের আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে রোকসানা বেগম বলেন, “সিদ্ধিরগঞ্জের ডাচ-বাংলা ব্যাংকে যেদিন আগুন লাগল, সুলাইমান সেখানেই ছিল। ওর সামনে লাশের পর লাশ পড়ে ছিল। আমাকে বলে, আম্মি, আমি গুলিতে আহত ছেলেগো সুগন্ধা হাসপাতালে নিয়া গেছি। আমি কইলাম, তুই গুলি খাইলে কে নিবে? আমার বাবায় তো গুলি খাইয়া যাত্রাবাড়ী রাস্তায় পড়ে ছিল, কেউ ওরে সময়মত হাসপাতালে নিয়া যায় নাই।” এ কথা বলেই অঝোরে কাঁদেন এই মা।

শহীদ সুলাইমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মাদানীনগর এলাকার মিরাজ ব্যাপারী ও রোকসানা বেগমের একমাত্র ছেলে। দুই কন্যা সন্তানের পর সুলাইমান ছিলেন বাবা-মায়ের বড় আশা। মিরাজ ব্যাপারী সৌদি প্রবাসী। দুই মেয়ের বিয়ের পর ছেলেকে নিয়েই ছিল রোকসানার সংসার। স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে বড় মাওলানা হবে।

উনিশ বছর বয়সী সুলাইমান মিরপুর দারুর রাশাদ মাদরাসায় পড়তেন। রোকসানা বলেন, ‘বড় আশা কইরা আল্লাহর কাছে চাইছিলাম, দুই মাইয়ার পর একটা ছেলে দেন। বড় মাওলানা হবে, আমি মারা গেলে আমার কবরের পাশে কোরআন তেলাওয়াত করব, আমার জানাজা পড়াইব। আমার ভাগ্যে এগুলা হইলো না।’

ছেলের সাথে শেষ স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সকালে ডিম ভাজি দিয়া খিচুড়ি খাইয়া গেছিল। ওরে যাইতে না করছিলাম, কিন্তু ও বলে, আম্মি, দেখেন, যাত্রাবাড়ীর ছাত্ররা ফজরের পরই নেমে গেছে, আমারেও যাইতে দেন। আমি কইলাম, তুই সামনে সৌদি চইলা যাবি, এগুলা তো স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জন্য। ও বলে, যে পুরুষ, সে কি এই অত্যাচার দেইখা ঘরে থাকে?’

মরণের আগেও সুলাইমান মানুষের সেবা করেছে জানিয়ে রোকসানা বলেন, ‘আমার বাবায় অনেক সাহস ছিল। জোহরের আজান যখন দিছে তখন ফোন ধরছে, শুনলাম কাগো সাবধান করে বলতাছে, ওইদিকে গুলি, ওইদিকে গুলি। এই গুলিই আমার বাবার গায়ে লাগছে। আযানের পর আর ফোন রিসিভ করে নাই। ও ফোন ধরছিল, কিন্তু আমার কথা শুনতে পারে নাই। এত আওয়াজে ও কিছু শুনে নাই। আমি ডাকছিলাম, সুলাইমান, সুলাইমান তুই কোথায়? ও আর শোনে নাই।’

জোহরের আযানের পর সুলাইমানের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তার দুলাভাই শামীম কবির বলেন, ‘সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো খবর পাইনি, খুঁজতে খুঁজতে রাতে ঢাকা মেডিকেল মর্গে লাশ পাই। পরদিন জানাজা দিয়ে মাদানীনগরের কবরস্থানে দাফন করা হয়।’

ছেলের মৃত্যুর নয় মাস পার হলেও রোকসানা বেগমের কান্না থামেনি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবায় দেইখা গেল, আমি গরুর গোশত রানছি। হাড্ডিওয়ালা গরুর গোশত পছন্দ ছিল ওর। ও আইয়া খাইবো, এই আশায় ছিলাম, কিন্তু আর আইল না। চব্বিশ ঘণ্টায় আমার বাবার কথা মনে পড়ে। সকালের সময় জিগাইতো, কি নাস্তা করব আজকে? ১০ মাস পার হইলো, আর জিগায় না, কি খাইবো আম্মি। আমার ছেলের স্মৃতি তো আর ভুলতে পারি না।’

দুলাভাই শামীম কবির জানান, ছেলের মৃত্যুতে রোকসানা শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একা থাকতে পারেন না, মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে দুই মেয়ের কাছে যান। একা থাকলে কান্না থামে না।

আর্থিক সহায়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে কিছু টাকা পেয়েছি। জামায়াত থেকে ২ লাখ টাকার অনুদানও পাইছি।’

ছেলের হত্যার বিচার দাবি করে রোকসানা বলেন, ‘আমার ছেলেরে যারা মারছে, তাদের বিচার চাই। আমার মতো হাজারো মায়ের বুক খালি করছে, সেই খুনিদের ফাঁসি চাই।’

সরকার প্রকাশিত গেজেটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের তালিকায় সুলাইমানের নাম ৩৭২ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *