‘দেশ খুব ভালো আছে। এক বছরে আমেরিকা হয়ে গেছে, আর আমরা সবাই খুব ভালো আছি।’
এমন কথা শুনতে স্বপ্নময় মনে হয় — যেন দেশে আর কোনো শোক নেই, ক্ষোভ নেই, বেদনা নেই। মনে হয় মানুষ যেন স্বপ্নে ভাসছে, যেখানে সব পথ মসৃণ, যেখানে প্রশাসন সজাগ, আইনশৃঙ্খলা নিখুঁত, আর মানুষের মনে কোনো ভয় নেই। ক্ষুধা, দারিদ্র্য তো নেইই!
কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই এমন?
কুমিল্লার মুরাদনগরে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনার ভাঙা আয়না আমাদের নির্মম বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়। একজন নারীকে ধর্ষণের পর বিবস্ত্র অবস্থায় নির্যাতিতর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজ মাধ্যমে। চোখে না দেখলেও, কানে না শুনলেও, এই সভ্যতার মুখোশকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে এমন বর্বরতার ছবি।
স্বাধীন দেশে আমরা কতোটুকু সভ্য হলাম? নির্যাতিতকে উদ্ধারের পর যেখানে এলাকার বয়স্ক নারী-পুরুষ তার জিম্মাদার হবেন, অভয় দেওয়ার পাশাপাশি তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন, সেখানে উল্টো একদল দুর্বৃত্ত তাকে ঘিরে ধরে ভিডিও করার জান্তব উল্লাসে মেতে উঠছে, নির্যাতীতাকে আরো অসংখ্যবার মানসিক ধর্ষণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে ওইসব ভিডিও ক্লিপে।
বলা ভাল, বিচারহীনতার দীর্ঘতর ইতিহাসের শিকড় অনেক গভীরে। যে কারণে মুরাদনগরেই থেমে যাবে না এমন নেতিবাচক ঘটনা। এ ঘটনার রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই খবরে প্রকাশ, গাইবান্ধায় একটি শিশু ধর্ষণের জেরে দলবদ্ধ পিটুনিতে নিহত হয়েছে অভিযুক্ত যুবক।
আসলে যখন রাষ্ট্র নাগরিকের ন্যূনতম মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন বিবেকও যায় ধীরে ধীরে মরে, আর নৈতিকতা ক্ষয় হতে হতে ঠেকে গিয়ে তলানিতে। তখন মনুষত্বহীনতাই যেন নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা।
এরপরেও নিশ্চিত বলা হবে, ‘এসবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে, দোষী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে!’ আর জুড়ে দেওয়া হবে সেই গৎ বাধা বুলি, ‘আমরা দেখছি, কী করা যায়!’

আর সাধারণ মানুষের এসব ঘটনাও যেন দিন দিন গা সয়ে যাচ্ছে, বিচারহীনতা দেখতে দেখতে চোখ ক্ষয়ে যাচ্ছে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বুলিতে বধির হয়ে যাচ্ছে কান, মস্তিস্কে পড়ছে স্থবিরতার ধূসর আস্তরণ।
অন্যদিকে রাজপথে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার ধর্মঘটে চট্টগ্রাম বন্দর কার্যত অচল। পণ্য খালাস বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি থমকে গেছে। ব্যবসায়ী নেতারা সংবাদ সম্মেলন ডেকে অসায়ত্ব প্রকাশ করে বলছেন, এ আন্দোলনে দিনে ক্ষতি প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা।
সবমিলিয়ে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা, সাধারণ মানুষও আতঙ্কে — জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কে জানে?
তার মধ্যেই রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত। নির্বাচন নিয়ে সংশয়, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন, বিভিন্ন সংগঠনের অসংখ্য দাবি-দাওয়া, আন্দোলন — সব মিলে চারিদিকে আরেক রকম অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। জমে উঠছে ভয়, অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ, যা কোনোভাবে আর চাপা থাকছে না।
মুরাদনগরে ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ যেন আমাদের নৈতিকতা, মনুষত্ববোধ, ঝিমিয়ে পড়ে বিবেক ও প্রতিবাদী স্বত্ত্বাকে চাবুক মেরে যায়। মরচে পড়া রাষ্ট্র কাঠামোকে আরেকবার আরেকবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আমূল সংস্কারের কথা বলে, যা জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম স্পিরিট।
৩৬ জুলাইয়ের এক বছরের মাথায় এখন সময় এসেছে, আংশিক নয়, পুরো সত্য বলার। সময় এসেছে, দৃষ্টি মেলে সাদাকালো দেখার, কান পেতে সবটুকু শোনার, কণ্ঠ ছেড়ে বলার– না, এমন বাংলাদেশ চাই না!