মু্‌হাম্মদ ইউনূসের ৮৫তম জন্মদিন, ফৌজদারি আসামি থেকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান

টাইমস রিপোর্ট
4 Min Read
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা  মুহাম্মদ ইউনূসের ৮৫তম জন্মদিন শনিবার। তিনি ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনে মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু ব্যক্তি, সংগঠন ও শুভানুধ্যায়ী।

নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ  গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে  সর্বদলীয় সম্মতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত হন। মূল রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মধ্যস্ততায় গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে কাজ করছে।

যেখানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার এক সময় তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, শ্রম আইন লঙ্ঘনসহ একাধিক ‘হয়রানিমূলক’ মামলা করে, যা এখন  আদালতে খারিজ হয়েছে। সমালোচকরা আগেই বলেছিলেন, মামলাগুলোর ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ ছিল; বর্তমান বাস্তবতা যেন সেই দাবিকে সত্য প্রমাণ করেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও ইউনূসের নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে—বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, বিচার বিভাগীয় স্বচ্ছতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউনূস নিজে এখনও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মন্তব্য করেন না, তবে তার নেতৃত্বে দেশ একটি নতুন গণতান্ত্রিক যাত্রার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দুলা মিঞা সওদাগর ছিলেন একজন মহুরী এবং মাতা সুফিয়া খাতুন গৃহিণী। তার স্ত্রী অধ্যাপক দিনা আফরোজ, দাম্পত্য জীবনে তাদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।

মু্‌হাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন। নোবেল ছাড়াও তিনি বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন, যা তাকে বিশ্বমঞ্চে একজন মানবকল্যাণে নিবেদিত সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। চট্টগ্রামের কলিজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৩৯ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৬তম স্থান অর্জন করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।

১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করেন। সেখানে তিনি ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট-এ অধ্যয়ন করে ১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৯৭১ সালে ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে  অবস্থানকালে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করেন। তিনি অন্যান্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিলে ‘বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার’ পরিচালনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও সমর্থন গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। সে সময় তিনি গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’ চালু করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে এই প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

গ্রামীণ ব্যাংক মডেল আজ বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে বিস্তৃত, এবং এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে আমেরিকাসহ প্রায় ৪০টি দেশে এই মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে।

দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য মুহম্মদ ইউনূস দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি সেই অল্পসংখ্যক ব্যক্তির একজন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল- এই তিনটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মাননা অর্জন করেছেন।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *