মিরপুরের আকাশজুড়ে যখন আনন্দের ছাপ, মৃদু বাতাস বয়ে আসছে হোম অফ ক্রিকেটে—বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের ২৫ বছর পূর্তির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যেন এক মহা উৎসব। তবে, ঠিক তখনই হাজার মাইল দূরের কলম্বোতে দৃশ্যপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে উদযাপনের বদলে বাংলাদেশ দলের জন্য অপেক্ষা করছিল বাস্তবতার নির্মম ছায়া। আর সেই ছায়ার রূপ ছিল—পাথুম নিশাঙ্কার ব্যাট।
দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিনে, যখন বাংলাদেশ ২৪৭ রানে অলআউট হয়ে ফিরেছে প্যাভিলিয়নে, তখন শ্রীলঙ্কা কাঁপিয়ে দিল ব্যাট হাতে। দিন শেষে স্কোরবোর্ডে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ২৯০/২। ৪৩ রানের লিড, ৮ উইকেট হাতে। তবে সংখ্যাগুলো দিয়ে বোঝানো যায় না কতটা নিয়ন্ত্রণে তারা খেলেছে কিংবা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বোলিং ইউনিট।
নিশাঙ্কা অপরাজিত ১৪৬ রান করে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন বাংলাদেশের বোলারদের আত্মবিশ্বাস। ২৩৮ বলের ইনিংস—দুর্দান্ত ধৈর্য, নিখুঁত টাইমিং আর অপরাজেয় নিয়ন্ত্রণে নির্মিত এক মহাকাব্য যেন। তাঁর সঙ্গে দিনেশ চান্দিমালের ৯৩ রানের মারমুখী ইনিংস মিলিয়ে গড়ে উঠেছে ১৯৪ রানের এক ধ্বংসাত্মক জুটি।
শুরুটা ছিল ভয়ংকর। নিশাঙ্কা ও লাহিরু উদারা মাত্র ৮.৫ ওভারে তুলেছিলেন ৫০ রান। বোলারদের যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না মাঠে—বল শুধু যাচ্ছে, প্রতিরোধ নেই। লাঞ্চের সময় স্কোর ছিল ৮৩/০।
বিরতির পর কিছুটা স্বস্তি এনে দেন তাইজুল ইসলাম। উদারাকে এলবিডব্লিউ করে দেন, যদিও প্রথমে আম্পায়ার ‘না’ বলেছিলেন, রিভিউতে আউট হয়ে যায়। ৮৮ রানের ওপেনিং জুটি ভাঙলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তারপর এলেন চান্দিমাল—আর যেন চলতে থাকল একপাক্ষিক খেলা। নিশাঙ্কার শান্ত ব্যাটিংয়ের পাশে চান্দিমালের আগ্রাসন গতি এনে দেয়। মাত্র ৬৪ বলে তাঁরা গড়েন ৫০ রানের জুটি। একটি ছক্কায় শতরান পার করে দেন শ্রীলঙ্কাকে।
টি ব্রেকের আগেই যোগ হয় আরও ১০৭ রান। আর বাংলাদেশ? তারা যেন কেবল দর্শক—নিজেদের টেস্ট জার্সি পরে।
টি-ব্রেকের পর নিশাঙ্কা পূর্ণ করেন তার চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরি—এই সিরিজেই দ্বিতীয়টি। তার পরেও ব্যাট করে যান নির্ভরতায়। ২৫০ পেরিয়ে যায় চান্দিমালের বাউন্ডারিতে। শেষ পর্যন্ত ৯৩ রানে এক রিভার্স সুইপে আউট হয়ে ফেরেন চান্দিমাল, নাঈম হাসানের বলে গ্লাভসে ছোঁয়া দিয়ে।
দিন শেষে উইকেটে ছিলেন নিশাঙ্কা (১৪৬*) ও নাইটওয়াচম্যান জয়াসুরিয়া (৫*)। ম্যাচের লাগাম ছিল শ্রীলঙ্কার মুঠোয়—আতশবাজি তখন শুধু মিরপুরেই।
এর আগে সকালে বাংলাদেশের ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ২৪৭ রানে। ব্যাটসম্যানদের আবারো সেই একই গল্প—শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। শাদমানের ৪৬, মুশফিকের ৩৫, লিটনের ৩৪—সবই ‘কি হতে পারত’র গল্প। তাইজুল শেষদিকে ৩৩ রান করে একটু মুখরক্ষা করলেও বড় সংগ্রহ হয়নি।
ওয়েল্লালাগে ও আসিথা ফার্নান্দো ৩টি করে উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে নাকাল করেন।
মিরপুরে আলোর ঝলকানির ভেতর ক্রিকেট ইতিহাসের এক চতুর্থাংশ যুগ উদযাপিত হচ্ছে—কিন্তু কলম্বোর আলো নিভে গেছে বাংলাদেশের জন্য। নিশাঙ্কার ব্যাট যেন সব উজ্জ্বলতাকে গিলে খেয়েছে। ২৫ বছরের টেস্ট যাত্রার দিনটা যে প্রতীকী হয়ে উঠবে বলে আশা ছিল—তা রূপ নিয়েছে এক বাস্তবতার নীরব প্রহারে।
কলম্বোর উইকেট বলছে, বাংলাদেশ এখনও বহু পথ পাড়ি দেওয়ার বাকি। আর সেই পথ শুরু হয় হয়তো এই হার মেনে নেওয়া থেকে।