সাত শীর্ষ সন্ত্রাসীর রাজনৈতিক সংযোগ

4 Min Read
ছবিতে বাম থেকে গ্রেপ্তারকৃত শুটার আরাফাত, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও শরীফ। ছবি: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
Highlights
  • 'রিমান্ডে এসব সন্ত্রাসীর গডফাদারদের পরিচয়ও বেরিয়ে আসার কথা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নির্মম সত্য জাতির কাছে প্রকাশ করার এখনই সময়।'

শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ফের আলোচনায় বাংলাদেশের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’। তিন দশকে কয়েকশ ‘ক্রসফায়ারের’ নিশ্চিত মৃত্যু অতিক্রম করেছেন তারা। পাশাপাশি জন্ম দিয়েছেন নানা প্রশ্নের। কোথায় তাদের খুঁটির জোর? এই সাত সন্ত্রাসীর গডফাদারই বা কারা?

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। তাদের গ্রেপ্তারের শর্তে ঘোষণা করা হয় পুরস্কারও। পুলিশ ও র‍্যাব হেফাজতে ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘এনকাউন্টারে’ বেশ কয়েকজন নিহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, তানভীরুল ইসলাম জয়, বিকাশ বিশ্বাস, প্রকাশ বিশ্বাস, জোসেফ এবং লেদার লিটন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যেকেই প্রশ্রয় পেয়েছেন কোনো না কোনো রাজনৈতিক প্রভাবশালীর।

শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। ফাইল ফটো

বিগত শেখ হাসিনার সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে বিকাশ, প্রকাশ এবং জোসেফ নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করেছেন। সুব্রত, মাসুদ, জয় ও লিটন ছদ্মবেশে দেশে যাওয়া-আসা করে নির্বিঘ্নে চালিয়ে গেছেন ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’। কখনো সরকারি উচ্চ পর্যায় বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে, আবার কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা– সবই চালিয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল কাইয়ুম জানিয়েছেন, ২০০১ সালে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়। তালিকাটি এখনো বহাল ও কার্যকর রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে এসব সন্ত্রাসীর গডফাদারদের পরিচয়ও বেরিয়ে আসার কথা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নির্মম সত্য জাতির কাছে প্রকাশ করার এখনই সময়।’

বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলম টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাতিরঝিলে এক ছাত্রদল নেতাকে গুলি করাসহ সুব্রত বাইনের গত দশ বছরের সক্রিয়তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

আইজিপি বলেন, ‘পুলিশের কোনো সদস্য কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তি তাদের সহায়তাকারী হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, জয় ও লেদার লিটনের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং’ (র) -এর গোপন আঁতাত তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। তার অনুসন্ধানে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের সংশ্লিষ্টতার তথ‍্য উঠে এসেছে।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা পরিচয় গোপন করে দেশত্যাগ করেছে– এ খবর সঠিক হলে আমাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতাও প্রমাণিত হয়।’

আন্ডারওয়ার্ল্ডের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪-১৮ সালে একটি রাষ্ট্রীয় ‘টার্গেট অপারেশনে’ সুব্রত বাইনকে ব্যবহার করা হয়েছিল।

সূত্র মতে, এর আগে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে মগবাজারের বাসিন্দা সুব্রতর এক প্রতিবেশী, তৎকালীন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী তাকে নিরাপদে দেশ ছাড়তে সহায়তা করেন।

একসময় পুরনো ঢাকার এক বিএনপি নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন মোল্লা মাসুদ। পরে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ‘ভূমিকা’ রাখার সূত্রে পৌঁছে যান ক্ষমতার শীর্ষে।

আদালত সুব্রত বাইনের ৮ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। ছবি: সংগৃহীত

বিকাশ বিশ্বাসের জন্ম বাগেরহাটে হলেও আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের আশ্রয়ে ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন সহজেই। ২০১৮ সালে গোপনে দেশত্যাগও করেন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সহায়তায়। অভিযোগ আছে, বিকাশ এখনো ফ্রান্সে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকার অপরাধ চক্রের একাংশ।

তার ভাই প্রকাশ বিশ্বাস ছিলেন মিরপুরের সন্ত্রাসী। ‘ক্রসফায়ার’ এড়াতে তালিকাভূক্ত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের সহায়তায় চলে যান ইউরোপে। অপরাধ জগত থেকে বেরিয়ে এসে সেখানে ‘আইন’ বিষয়ে পড়ালেখা করেন। এখন সেখানে যাপন করছেন স্বাভাবিক জীবন।

১৯৯৬ সালের আলোচিত হত্যায় মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন জোসেফ। তৎকালীন সেনাপ্রধানের ভাই হওয়ার সুবাদে ২০১৮ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই পাড়ি জমান বিদেশের নিরাপদ আশ্রয়ে।

তানভীরুল ইসলাম জয় ছিলেন বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও শেখ পরিবারের এক সদস্যের ঘনিষ্ঠ। শেখ পরিবারের ওই আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগ দেন ভারতের মধ্যপ্রদেশের এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এবং দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকেন দেশ-বিদেশে।

এছাড়া আরেক আলোচিত সন্ত্রাসী লেদার লিটন এক সময় ছিলেন হাজারীবাগের লেদার ইন্সটিটিউটের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকারী। শীর্ষ সন্ত্রাসী জয়ের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে মুর্শিদাবাদ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন।

এমনকি লেদার লিটনের বিরুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার জন্য তথ্য সংগ্রহ, অস্ত্র ও মাদক চোলাচালানে সক্রিয় থাকার গুরুতর তথ্যও রয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্টে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *