রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা পরিবারগুলোর অনেকেই এখন দিনে ২,১০০ ক্যালোরিরও কম খাদ্যে চলতে বাধ্য হচ্ছে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের সহায়তায় প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ২০ শতাংশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এ অবস্থায় খাদ্য রেশন কমে যাওয়ায় বেড়েছে অপুষ্টি আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও ব্যাহত হচ্ছে।
এই বাস্তবতায় রোববার থেকে কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক অংশীজন সম্মেলন। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অষ্টম বার্ষিকীতে আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন এবং এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কক্সবাজারে এই সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সরকারের কর্মকর্তারা।
সম্মেলন ঘিরে রোহিঙ্গা ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা– ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে সংকটের মূল কারণ মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
টাইমস অব বাংলাদেশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশের যোগাযোগ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন,‘এই সম্মেলন বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সংকটের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যার সমাধান রয়েছে মিয়ানমারে। রোহিঙ্গারা তখনই স্বেচ্ছায়, নিরাপত্তা ও মর্যাদাসম্পন্নভাবে ফিরতে পারবে, যখন সেখানে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি হবে।’
তিনি আরও বলেন,‘বাংলাদেশি জনগণ তাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদেরও সহায়তা করা জরুরি। এই সবকিছুই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় সহায়তার ওপর নির্ভর করছে।’

চার দিনের এই সম্মেলন আয়োজিত হচ্ছে আন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে। আগামী মাসে নিউইয়র্কে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অনুষ্ঠেয় উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আগে এটি একটি প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সম্মেলনের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ফলাফল নির্ভর করবে অংশগ্রহণকারীদের আলাপ ও সেই অনুযায়ী বাস্তব পদক্ষেপের ওপর। তাদের ভাষায়, ‘এই সংকট শুধু মানবিক নয়, রাজনৈতিকও।’
সংস্থাটি আরও জানায়, তারা আগের মতোই বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে এবং রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সেবা ও টেকসই সমাধানের জন্য সব অংশীজনকে যুক্ত করার চেষ্টা চলবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা চাইছেন, এই সম্মেলনে যেন শুধু বক্তব্য নয়, বাস্তব প্রতিশ্রুতি আসে। কুতুপালং শিবিরের যুব প্রতিনিধি ইউনূস আরমান বলেন,‘প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবারই রাখতে চায় নিজ দেশে ফেরার স্বপ্ন।
কিন্তু সেটি হতে হবে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণভাবে। ততদিন আমাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা এবং জীবনে সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।’
আরেক রোহিঙ্গা নেতা সায়েদ উল্লাহ বলেন,‘আমরা বছরের পর বছর অনিশ্চয়তায় পড়ে আছি। আশার আলো ছাড়া যুগের পর যুগ শরণার্থী হিসেবে বেঁচে থাকা যায় না। এই সম্মেলনে ফিরে যাওয়ার রূপরেখা ও বর্তমান জীবনের মান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দুটোই থাকতে হবে।’
সংকটের শুরু ও বাংলাদেশের অবস্থান
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরু হলে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর সময়ের সঙ্গে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১০ লাখে।
আট বছর পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক মনোযোগও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন,‘সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ এতদিন এই বিশাল চাপ সামাল দিচ্ছে। এই সম্মেলন যেন বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়- সমাধান মিয়ানমারে। তবে সেই সমাধান আসা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।’
পর্যবেক্ষকদের মতে, কক্সবাজারের এই অংশীজন সম্মেলন নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের জন্য ভিত্তি তৈরি করবে। সেখানে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক অংশীদাররা রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান, মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং কূটনৈতিক চাপ জোরদারের আহ্বান জানাবে।