শাশুড়ি ফ্যাসিস্ট নাকি ফেমিনিস্ট?

টাইমস রম্য
8 Min Read
প্রতীকী গ্রাফিক্স

পয়লা বৈশাখের বর্ণিল আয়োজনে হাজার হাজার মানুষ যখন ঢাকার রাস্তায় আনন্দ শোভাযাত্রায় হাঁটছিলেন, তখন বিশেষ এক মুখাবয়ব দেখে এক নারী হাসতে হাসতে অন ক্যামেরা বলে ওঠেন, “ফ্যাসিস্টের ছবিটা আমার শাশুড়ির মতো লাগছিল! হি হি হি… উনার চেহারার সাথে অনেক মিল আর কি, এজন্য শাশুড়ির মতো লাগছিল। হি হি হি…. আমার শাশুড়ির চেহারা এরকমই। সবাই ত শাশুড়িকে একটু ভয় পায়। সেই হিসেবে একটু শাশুড়ির মতো লাগছিল।”

মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে তা ভাইরাল। ফানি ফানি কথাগুলো মজার, তবে প্রতীকীও বলে মনে করেন অনেকে। এ নিয়ে তুমুল আলোচনায় সবকিছুর জন্য কারো আঙুল ভয়ঙ্কর শাশুড়ির দিকে, কারো কাছে অভিযুক্ত চালবাজ বউ। কেউ বলছেন “মুখোশ ত নয়ই, মুখও নয়; মনটাই মুখ্য!”

আসলে বাঙালি জীবনে বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক মানেই এক আদি ‘আড়ি দেওয়া-আড়ি ভাঙা রসায়ন’। হুট করে ভালো, হুট করে খারাপ, অনেকটা ইংলিশ ওয়েদার। এ যেন ভালোবাসা আর প্রতিযোগিতার ককটেল। এই সম্পর্কের একটি সামাজিক জ্যামিতিও আছে, যেখানে বউ শাশুড়ির মুখের হাসির আড়ালে দাঁত কিংবা নখ কামড়ানো থাকে—“দেখি কে কাকে শেখায় সংসারের পাঠ!”

এ প্রসঙ্গেই চলে আসে বিখ্যাত সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়া “আড়ি”। ছড়াটির কোথাও বউ বা শাশুড়ির কথা নেই, তবু মনস্তত্ত্ব যেন হুবহু এ সম্পর্কেরই ছায়া। কেমিস্ট্রিটা গুগলও ভালো বুঝে নিয়েছে। না হলে বউ-শাশুড়ির নিয়ে একটা ছড়ার সাজেশন চাইলে, গুগল মামা কেন ‘আড়ি’র কথাই বলবে সবার আগে!

সে যাই হোক, ছড়াটি যাদের পড়া নেই; কিংবা যারা ভুলে গেছেন ছড়াটির আদ্যোপান্ত, তারা চাইলে আরেকবার পড়ে নিতে পারেন:

‘কিসে কিসে ভাব নেই? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে—
বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে।
শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি,
সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী!
আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনোদিন্ সে?
কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয়।
তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখনি?
ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ রাগ যেন খেতে আসে এখনি।
তার চেয়ে বেশি আড়ি পারি আমি কহিতে—
তোমাদের কারো কারো কেতাবের সহিতে।’

এই ছড়ার আবহে আজকের বউ-শাশুড়ি সম্পর্ককে যদি দেখি, তাহলে এটা সত্যিই দীর্ঘস্থায়ী এক “আড়ি-দৃষ্টি-ভাব”। কেউ কারও দিকে চাইছে না, আবার চাইতেও ছাড়ছে না।

রায় বাবুর ননসেন্স রাইম থেকে যদি একটু ঠাকুর মহাশয়ের ক্লাসিক সাহিত্যে প্রবেশ করি, সেখানেও আছে বউ-শাশুড়ির সার্বজনীন সত্যের কথা। এখন মাঝে মাঝে ভা্বি যে ছোটবেলায় ইউনিভার্সাল ট্রুথের ট্রান্সলেশন শেখাতে গিয়ে মাস্টারমশাইরা কেন শুধু সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয় আর পশ্চিম দিকে অস্ত যায় কিংবা পৃথিবী সূর্যর চারদিকে ঘোরে শিখিয়েছেন, কেন বউ শাশুড়ি নিয়ে ইউনিভার্সাল ট্রুথটা শেখালেন না!

পাঠ্যবইয়ের লেখক কিংবা ক্লাসরুমে বা প্রাইভেটে ইংরেজি পড়ানো স্যারদের ত আর পাবো না, তাই জিজ্ঞেস করার সুযোগ নেই। তবে বাঙালীর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন সারাজীবনের জন্য।

তাঁর “শেষের কবিতা”-তে লাবণ্য আর অমিতের প্রেমকথার দার্শনিকতার পাশাপাশি অমিতের মায়ের উপস্থিতিকেও ‘আনডারলাইন’ করা যায়। শাশুড়িরা যে ঠিক কী চান, তার প্রথম দৃষ্টান্ত এক অর্থে সেই উপন্যাসেই মেলে— যেখানে লাবণ্যর ভবিষ্যত শাশুড়ি লাবণ্যকে অমিতের যোগ্য ভাবেন না। কারণ “সে তো ঘরের মেয়ে না”, “সে তো বেশি পড়াশোনা করে”, “ছেলেকে কবিতা শিখিয়ে পাগল করে দেবে”। এইসব মন্তব্যে শাশুড়ির মনের ভেতরের “বউ-বাছাই মনস্তত্ত্ব”টাই যেন ফুটে ওঠে।

লাবণ্যর সেই দূরত্বগ্রস্ত সম্পর্কের অভিজ্ঞতা যেন আজও অনেক বউয়ের জন্য বাস্তব। এখানে বুদ্ধিমতী হওয়া আবার বড় সমস্যা! শাশুড়ি ভাবেন—“বউ যদি আমায় ভুল প্রমাণ করে, তবে সংসার কার হাতে?” আবার বউ ভাবে—“শাশুড়ি ত আমায় সাবেকি খাঁচায় পুরে ফেলতে চায়!”

এই দ্বন্দ্বকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন অনেকেই। যেমন হুমায়ুন আজাদ তার “বউ” কবিতায় লিখেছেন:
“সে আমার স্ত্রী নয়,
সে আমার মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। “

এখানে দুই নারীর দ্বৈরথ, যা প্রেমের মানুষটিকে ভাগ করে ফেলে।

আবার আহসান হাবীব তাঁর ছড়া ‘তুমি আর আমি’–তে শিশুসুলভ টোনে বলেন—

“তুমি বলো ওঠো ওঠো‘‘আমি বলি ঘুমাও
তুমি বলো ভাত খাও
আমি বলি চা খাও…”

ছোট করে হলেও, এই “আমি-তুমি” দ্বন্দ্বই যেন প্রতীক হয়ে ওঠে বউ-শাশুড়ির।

শাশুড়ি যখন চান ছেলে তার টিভি দেখতে দেখতেই ড্রয়িং রুমে বসে ডিনারটা সারুক, বউ তখন কড়া সুরে বলে, ডাইনিংয়ে। এ নিয়ে বউ-শাশুড়ির মধ্যে হয়তো কটু বাক্য বিনিময় হয় না, কিন্তু সিসি ক্যামেরা থাকলে বলে দেওয়া যেত, কার চোখ কার দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে!

জসীমউদ্দীন তাঁর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’-এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়ের দুঃখের যে এক দীর্ঘ অনুপম প্রতিচিত্র এঁকেছেন, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই দুঃখের উৎস সংসারের অভিভাবক নারী— অর্থাৎ শাশুড়িরাই।

এ নিয়ে কত রাত বিনিদ্র কাটে কত বউয়ের! কিংবা হারানোর বেদনায় শাশুড়িরও কম না।

তবে রম্যটা যদি সাহিত্য থেকে সমাজে ফেরাই, তাহলে দেখি— এ সম্পর্ক শুধুই সংঘাতের নয়, তা মজা-মধুরতায়ও কম ভরপুর নয়।

একজন নতুন বউ যখন ঘরে আসে, শাশুড়ি বলেন, “এই তো, আমার আরেক মেয়ে!” কিছুদিন পর বলেন, “মেয়ের মতো হলেও নিজের মেয়েতো না!” আর আরো কিছুদিন পর … “বউটা আমার ছেলেটারে পাল্টায়া দিল রে মা!”

অন্যদিকে বউ ফোনে তার মা-কে বলে, “আমার শাশুড়িটা না, দিব্যি একা একা বসে নাটক দেখে। আমি গেলেই বলে, ঐ চ্যানেলটা ভালো না!” মতের ভিন্নতা এখানে নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু তাতে বন্ধন ভাঙে? হয়তো, হয়তো না।

রম্য না হোক, বউ-শাশুড়ি নিয়ে কবিতা ত আরো আছে। যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কবিও লিখেছেন। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও তাঁর ‘মেজাজ’ কবিতায় আছে:
“থলির ভেতর হাত ঢেকে
শাশুড়ি বিড়বিড় ক’রে মালা জপছেন;
বউ গটগট গটগট ক’রে হেঁটে গেল।”

সাহিত্যকে মহাসাগর বললেও কম বলা হয়। সেখানে কোনো কিছুর অনুসন্ধান বৃথা। তাই বউ-শাশুড়ি নিয়ে সাহিত্য বাদ থাকুক। বরং একটু সিনেমা দেখি।

বাংলা সিনেমায় বউ-শাশুড়ির কেমিস্ট্রির পাশাপাশি ফিজিক্স এবং ম্যাথও কম নেই। তবে, খোঁজ দ্য সার্চ করে শুরুতে যা পাওয়া গেল সেটা সেল্ফ এক্সপ্লেনেটরি। সিনেমার নামই যদি হয় ‘বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ’ তখন এ নিয়ে আর বলার কিছু থাকে না।

বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ সিনেমার পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

ওই সিনেমায় শাশুড়ি বানানটা দ্রষ্টব্য। আগের শাশুড়ী এখন শাশুড়ি হয়ে গেছেন। এরকম পরিবর্তনের মতো বউ-শাশুড়ির সম্পর্কেও বিবর্তন হচ্ছে।

শাশুড়ি এখন বউয়ের সঙ্গে রিল বানান, ফেসবুকে লাইক-কমেন্টও করেন। টাকাকড়ি থাকলে কেউ বউয়ের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে যান, বউয়ের পছন্দের জামাও পরেন। সেটা আবার দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে শাশুড়ি হলে তার ফেসবুকে।

বউ-ও বলে, “আমার শাশুড়িটা না, একদম বেস্টফ্রেন্ড!”

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই সম্পর্ক ‘ফলো-আনফলো’রূপে আরও জটিল ও রঙিন হয়ে উঠেছে। শাশুড়ি যে বউয়ের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকেন, সেটাকে বউ হয়ত মনে করে, টোয়েন্টি ফোর/ সেভেন সিসি ক্যামেরা। ‘টুপ’ করে অবশ্য আনফ্রেন্ড করতে পারে না। যদিও মন চায় শুধু আনফ্রেন্ড না, ব্লক লিস্টেই পাঠিয়ে দেই।

আসলে মন কী চায়, কে জানে!

তারপরও বলতেই হয়- বউ-শাশুড়ির সম্পর্কটা ফ্যাসিস্ট বনাম ফেমিনিস্ট না, বরং ‘ইগো বনাম ভালোবাসা’র এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব। কখনো গম্ভীর, কখনো রম্য, কখনো তিক্ত, কখনো অশ্রুভেজা।

তবে একটা কথা সত্য— এ সম্পর্ক নিয়ে যত ছড়া, কবিতা, উপন্যাস লেখা হোক না কেন, একে বোঝার শেষ নেই।

আর সে কারণেই হয়তো কেউ শাশুড়ির মুখ দেখেই বলে—“এই মুখটা যেন রাজনীতির প্রতীক নয়, আমার ব্যক্তিগত বিপ্লবের শুরু!”

অবশ্য কথা আরেকটা আছে।

প্রতীকী গ্রাফিক্স

ফ্যাসিস্টের মুখে নিজের শাশুড়িকে দেখা ওই নারী যখন ক্যামেরায় কথা বলছিলেন, তখন পেছনে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে সে মনে হয় তার পুত্রধন। আমাদের এটাও ভাবতে হবে, ছেলেটা যখন বিয়ে করবে; মানে ওই নারী নিজেই যখন শাশুড়ি হবে, তখন না জানি বউয়ের কাছ থেকে তাকে কোন উপাধি পেতে হয়!

অন্তত ফ্যাসিস্টের মতো যেন না দেখায়; সেজন্য প্লাস্টিক সার্জারি না হোক, বিউটি পার্লারে রূপচর্চা বাড়িয়ে দেওয়া একটা অপশন হতে পারে।

বউ-শাশুড়িরা কী বলেন? মানে যিনি শাশুড়ি হওয়ার আগে বউ ছিলেন, কিংবা যে বউ আগামীতে শাশুড়ি হবেন।

(একটি রম্য রচনা)

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *