চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে নিজের দেশ ইরানে বারবার কারাবন্দি হয়েছেন। তার ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। সেই জাফর পানাহি কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বর্ণপাম জিতলেন। প্রতিশোধমূলক কিন্তু কমেডি থ্রিলার ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’-এর জন্য এই সম্মান পেলেন তিনি। স্বর্ণপাম জয়ের মাধ্যমে বিরল এক কীর্তি গড়েছেন ৬৪ বছর বয়সী এই নির্মাতা। ইউরোপের শীর্ষ তিন চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার জয় করা একমাত্র নির্মাতা এখন জাফর পানাহি। ২০১৫ সালে ‘ট্যাক্সি’র জন্য বার্লিনের স্বর্ণভালুক (গোল্ডেন বিয়ার) ও ২০০০ সালে ‘দ্য সার্কেল’ ছবির সুবাদে ভেনিসে স্বর্ণসিংহ (গোল্ডেন লায়ন) জিতেছেন তিনি।
কান-মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইরানি শাসনব্যবস্থার বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন জাফর পানাহি। স্বদেশিদের শত প্রতিকূলতাকে একপাশে সরিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের দেশ ও আমাদের দেশের স্বাধীনতা। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের কী ধরনের পোশাক পরা উচিত, কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয়, সেসব বলার সাহস কারোরই থাকা উচিত নয়। চলচ্চিত্র হলো একটি সমাজ। আমাদের কী করা উচিত বা কী করা থেকে বিরত থাকা উচিত সেগুলো বলার অধিকার কারো নেই। আসুন আমরা বুকে আশা বাঁধি।’

সানগ্লাস পরা জাফর পানাহি স্বর্ণপাম গ্রহণের পর নিজের বক্তৃতার সময় মঞ্চে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবির কলাকুশলীদের ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি তিনি। তার বক্তব্যের ফরাসি অনুবাদ করে দিয়েছেন এক তরুণ। সবশেষে জাফর পানাহি বলেন, ‘আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কান উৎসবকে ও এখানে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানাই।’
শনিবার কান উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে জাফর পানাহির হাতে স্বর্ণপাম তুলে দেন অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী কেট ব্ল্যানচেট ও এবারের আসরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারক ফরাসি অভিনেত্রী জুলিয়েট বিনোশ। পুরস্কার প্রদানের ঠিক আগে অস্কারজয়ী বিনোশ বলেন, ‘শিল্পকলা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রাণবন্ত অংশে এমন একটি সৃজনশীল শক্তি এনে দেয় যা অন্ধকারকে ক্ষমা, আশা ও নতুন জীবনে রূপান্তরিত করতে পারে। এজন্যই আমরা স্বর্ণপামের জন্য জাফর পানাহির “ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট” ছবিটিকে বেছে নিয়েছি।’

জুলিয়েট বিনোশ ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবির নাম ঘোষণা করতেই এর কলাকুশলীরা আনন্দ-অশ্রুতে মিশে গেলেও জাফর পানাহি নিজের আসনে বসে দুই হাত চেয়ারের ওপরের অংশে রেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ছিলেন। এ যেন কারাবাসের খড়্গ মাথার ওপর থাকার পরও চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাওয়া একজন মানুষের সফল হওয়ার বহিঃপ্রকাশ।
‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ ছবির গল্প বাহিদকে কেন্দ্র করে। সে নকল পাওয়ালা এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে, যিনি দেখতে ঠিক সেই ব্যক্তির মতো যে বাহিদকে কারাগারে নির্যাতন করতো। সেসব দিন তার জীবনের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। বাহিদ অন্য কারাবন্দিদের সঙ্গে যাচাই করতে বেরিয়ে পড়ে যে, লোকটি সত্যিই তাদের নির্যাতনকারী কিনা।

ইরান সরকারের সমালোচনাকারী দুই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে বন্দি রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কারণে সর্বশেষ কারাবাস করতে হয়েছে জাফর পানাহিকে। ২০২৩ সালে তিনি মুক্তি পান। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকায় দীর্ঘ ১৫ বছর পর কানযাত্রার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কোনো উৎসবে সশরীরে অংশ নিলেন গুণী এই নির্মাতা। ২২ বছর পর কানে সশরীরে হাজির হয়েছেন তিনি। এবারের আসরের আগে সর্বশেষ ২০০৩ সালে উৎসবটিতে দেখা গেছে তাকে। সেই আসরে আঁ সাঁর্তে রিগা বিভাগে প্রদর্শিত তার ‘ক্রিমসন গোল্ড’ ছবিটি জুরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।
১৯৯৫ সালের কান উৎসবে জাফর পানাহির ‘হোয়াইট বেলুন’ ক্যামেরা দ’র পুরস্কার জিতেছে। ২০১৮ সালে তার পরিচালিত ‘থ্রি ফেসেস’ সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছে কানে। ২০১১ সালে জাফর পানাহির ‘দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম’ জন্মদিনের কেকের ভেতর লুকানো একটি ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ইরান থেকে নিয়ে কান উৎসবে বিশেষ প্রদর্শনী করা হয়।