ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রার’ মোটিফে আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে পুলিশ। ঘটনাটি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মনে করলেও পুলিশ অপরাধীদের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেখানে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ভোর বেলায় জিন্স প্যান্ট ও কালো শার্ট পরা এক যুবককে ঘটনাস্থলে দেখা গেছে বলে দাবি করেছে।
মোটিফে আগুন দেওয়ার এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনসহ ছাত্রলীগের পরিচয়বিহীন ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ। শনিবার বিকালে শাহবাগ থানায় মামলাটি করা হয়।
শাহবাগ থানার ওসি মো. খালিদ মনসুর বলেন, ‘ঢাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাওয়া সন্দেহভাজন যুবককে শনাক্ত করতে আমরা কাজ করছি।’
মামলাটি করেছেন ঢাবির এস্টেট অফিসের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমানুল্লাহ। তিনি এজাহারে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও সহযোগী অঙ্গ সংগঠন এবং ছাত্রলীগসহ নাম না জানা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। আসামিরা ‘ভীতি সঞ্চারের জন্য অন্তর্ঘাতমূলক’ এই কাজের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা বানচালসহ দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আগুন দিয়েছেন বলে তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্) এস এন মো. নজরুল ইসলাম ঘটনাস্থল চারুকলা পরিদর্শন করে বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে দেখে যেটা মনে হচ্ছে এটা এক্সিডেন্টাল না, কেউ ইনটেনশনালি এটা করছে। এটুকু আমরা নিশ্চিত।’
‘একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। এখানে চতুর্পাশে অনেক ক্যামেরা আছে। আমরা ডিজিটাল রেকর্ডগুলো নিব, ফরেনসিক করব। ডিটেকশন করে ফেলব ইনশাল্লাহ।’
অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তদন্তের এ পর্যায়ে বলার স্কোপ আসে নাই যে, পার্টিকুলারলি কারা করছে। এটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। এটা ইনভেস্টিগেশনে বের হবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। এখানে দুইটা মোটিফ পোড়ানো হইছে। বিগত সরকার প্রধান ছিল, তার একটা পোট্রেইট করা হইছে। ওইটা পোড়াইতে গিয়া সম্ভবতো কবুতরের আংশিক অংশ পোড়ানো হইছে। তাইলে ওই জিনিসটা যারা লাইক করে না, তারা এই কাজটা করবে। এটা একটা অনুমান নির্ভর কথা।’
ভিডিও ফুটেজ সম্পর্কে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল বলেন, ‘যে এখানে আগুনটা লাগাইছে, তারে ডিটেক্ট করতে পারলে তার মাস্টারমাইন্ড কারা বা এটার সাথে কারা জড়িত এইটার ডিটেইল আমরা পরে বলতে পারব। এখানে পুলিশ ছিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রক্টরিয়াল টিম ছিল। প্রক্টরিয়াল টিমের দুইজন সদস্য ছিল, ৫টার দিকে তারা সম্ভবত মসজিদে নামাজ পড়তে গেছে। পুলিশের টিমটা সম্পর্কে আমি এখনও ডিটেইলস জানি না। আমার এখানে ১০ জনের ফোর্স থাকে। গেইটে থাকে কিছু এখানে থাকে তিনজন। আমি ওদেরকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি নাই। জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে জানতে পারব তারা কই ছিল, কী অবস্থায় ছিল বা কীভাবে আগুনটা লাগছে। তাদের কাছ থেকে কিছুটা তথ্য পাওয়া যাবে। আর ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারব।’

বেলা পৌনে ১২টার দিকে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী চারুকলায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।
তবে ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কালো শার্ট পরা একজনকে আগুন দিতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইসরাফিল রতন।
তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় আজ ভোরের দিকে একজন ব্যক্তি এই প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে তার পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। ভোর বেলায় জিন্স প্যান্ট ও কালো শার্ট পরা এক যুবক ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে। তার মুখে মাস্ক ছিল, চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে তার মধ্যে কোনো ধরনের চাঞ্চলতা বা উদ্বিগ্নতা দেখা যায়নি। সে খুব ধীরস্থিরভাবে প্রতিকৃতিতে প্রথমে আগুন লাগায়। প্রথমে লাগানো আগুন কিছুক্ষণ জ্বলে নিভে যায়। পরবর্তীতে আবারো আগুন লাগায় সে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যুবকের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। তবে তার মুভমেন্ট দেখে বোঝা গেছে, এখানে পরিবেশ তার খুব পরিচিত।’
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিকে টার্গেট করে আগুন লাগানো হয়েছে। ওই আকৃতি পুরোটাই পুড়ে গেছে। একইসাথে পায়রার অবয়বটাও পুড়ে গেছে। আনুমানিক ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে আগুন লাগানো হয়েছে৷’
এ বছর বাংলা নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বাঁশ-বেতের কারুকাজে তৈরি করা হয়েছিল ২০ ফুট উচ্চতার দৈত্যাকৃতির “ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি”। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মুখাবয়বের দুপাশে ছিল শিংয়ের মতো অবয়ব। এটিই ছিল এবারের শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ।
শনিবার ভোরে চারুকলায় আগুনে শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ এবং ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ পুড়ে যায়।