‘মব সন্ত্রাসে’ নিঃস্ব ৭ পরিবার

শাহীন রহমান, পাবনা
5 Min Read
পাবনার ভাঙ্গুড়া বৃদ্ধমরিচ গ্রামের শাহাদতের বসতবাড়ি। ছবি: টাইমস
Highlights
  • মাইকে ঘোষণার কিছুক্ষণ পর শাহাদতের বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে একদল ‘সংঘবদ্ধ লোক’।

পাবনার ভাঙ্গুড়ায়  ‘হত্যা’য় জড়িত-এমন অপবাদে ‘মব সন্ত্রাস’; নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে  সাত পরিবার। ১০ জুন বৃদ্ধমরিচ গ্রামের সাতটি পরিবারের ১০টি ঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে ‘সংঘবদ্ধ’ একদল দুর্বৃত্ত।

জানা গেছে, মসজিদের মাইকে ‘মব সন্ত্রাস’ উসকে দেবার অভিযোগ স্থানীয় জামায়াতকর্মীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, ‘শুধুমাত্র সন্দেহের জেরে সাতটি পরিবারকে নিঃস্ব করার দায় কে নেবে?’

৯ জুন রাতে চণ্ডিপুর সিকেবি আলিম মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী ওসমান গণি মোল্লাকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওসমান গণি স্থানীয় কাজীপাড়া মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ওসমান গণির মৃত্যুর রাতেই বৃদ্ধমরিচ গ্রামের শাহাদত হোসেন তার প্রেমিকাকে নিয়ে ওসমান গণির কাছে যান। শাহাদত তাদের বিয়ে পড়াতে ওসমান গণিকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শাহাদতের স্ত্রী-সন্তান থাকায় ওসমান গণি বিয়ে পড়ানোতে অসম্মতি জানান। এরপরই খুন হন ওসমান গণি। ১০ জুন সকালে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে শাহাদতকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন স্থানীয়রা। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে আব্দুল বারিক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে ১০ জুন ভাঙ্গুড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্তরা হলেন- বৃদ্ধমরিচ গ্রামের মৃত বদিউজ্জামান সরকারের ছেলে রবিউল করিম, আব্দুর রহিম, নুরুল ইসলাম, আব্দুস সোবাহান, সাদ্দাম হোসেন, শাহাদত হোসেন ও লাইলী খাতুন। এদের মধ্যে নুরুল, সোবাহান ও সাদ্দাম মালয়েশিয়া প্রবাসী।

 অভিযোগ জামায়াত কর্মীর দিকে

ছবি: ফেসবুক থেকে
সাইদুর রহমান

ওইদিন সকালে মসজিদে মাইকিং করে তার বাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার আহ্বান জানান সাইদুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। সাইদুর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা।

মাইকে ঘোষণার কিছুক্ষণ পর শাহাদতের বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে একদল ‘সংঘবদ্ধ লোক’। শাহাদতসহ তার ছয় ভাই ও এক বোনের মোট সাতটি পরিবারের দশটি ঘর ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুর রহিমের স্ত্রী সাবিনা খাতুন বলেন, ‘সকালে সাইদুর রহমান মসজিদের মাইকে ঘোষণায় বলেন, শাহাদতের বাড়ি ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দাও। তখনি ১০ থেকে ১২ জন এসে হামলা করে। আসবাবপত্র, টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, চাল, ফসল এমনকি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেছে তারা।’

সাইদুরের জামায়াত সম্পৃক্ততার কথা স্বীকারও করেছেন উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মো. মহির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সাইদুর রহমান জামায়াতের কর্মী নন, তবে একজন সমর্থক। কিন্তু সাইদুর রহমান ভাঙচুরের জন্য মাইকিং করেননি।’

শাহাদত নয়, হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত দুই কিশোর

সেদিনই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মুল দুই অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করে পুলিশ। আটকরা হলো- বৃদ্ধমরিচ গ্রামের জেল হক প্রামাণিকের ছেলে হাবিব (১৪) ও চন্ডিপুর গ্রামের আসমত আলীর ছেলে আহমদ উল্লাহ (১৫)। ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বাীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই কিশোর। আদালতে কিশোরেরা মাদকের টাকার জন্য তারা বৃদ্ধ ওসমান গণিকে হত্যা করার বিষয়টি স্বীকার করেন। পরে সংশ্লিষ্টতা না থাকায় আটক শাহাদতকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙ্গুড়ার সেই সাত পরিবারের ঘরগুলো পড়ে আছে ভাঙচুর অবস্থায়। মাঝে কিছু সিমেন্ট ও বাঁশের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, ১০ থেকে ১২ জন বিভিন্ন বয়সী লোক এসে কোনো কথা না বলে অতর্কিত তাদের ওপর হামলা চালায়।

ক্ষতিগ্রস্তদের আগুনে পোড়া ঘর। ছবি: টাইমস

 ঘটনায় মামলা

ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে বড় ভাই রবিউল করিম বাদী হয়ে গত ১৮ জুন ভাঙ্গুড়া থানায় মামলা করেন। এতে ১৩ জন এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর পুলিশ ১৯ জুন তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

এ বিষয়ে ভাঙ্গুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, নৈশপ্রহরী ওসমান গণি হত্যার মুল দুই আসামি হাবিব ও আহমদ উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় সাইদুর রহমান, আনোয়ার হোসেন ও শাহীনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টতা না থাকায় ওসমান গণি হত্যার অভিযোগে আটক শাহাদতকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহযোগিতা চেয়েছেন অসহায় পরিবারগুলো।  লাইলী খাতুন বলেন, ‘আমার ছোট ভাই শাহাদতকে জড়িত সন্দেহ করে আমাদের ওপর বর্বর হামলা করেছে। প্রমাণ হলো আমার ভাই জড়িত নন। আমরা ক্ষতিপূরণ ও জড়িতদের শাস্তি চাই।’

ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার টাইমস অব বাংলাদেশকে  বলেন, ‘হামলার পর ক্ষতিগ্রস্তদের শুকনো খাবার, এক বান্ডিল করে টিন, প্রত্যেককে নগদ ৬ হাজার টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে।’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *