সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে ছড়া-কবিতা কম নেই। আজব ব্যাপার হচ্ছে, এরকম ছড়া-কবিতার সন্ধানে গুগল মামার শরণাপন্ন হলে তিনি সবার উপরে রেখেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’। কী বুঝে মামা এটা করলেন নিজের এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগ করেও বোধগম্য হলো না।
সে না হয় হলো। কিন্তু এ ফাঁকে আমরা ‘আবার পড়ো’র মতো কবিতাটি পড়ে নিজের ছোটবেলার কথা মনে করে চমকিত হতে পারি, ‘বাবুদের তাল-পুকুরে/ হাবুদের ডাল-কুকুরে/ সে কি বাস করলে তাড়া/ বলি থাম একটু দাড়া/ পুকুরের ঐ কাছে না/ লিচুর এক গাছ আছে না/ হোথা না আস্তে গিয়ে/ য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে/ গাছে গো যেই চড়েছি/ ছোট এক ডাল ধরেছি/ ও বাবা মড়াত করে/ পড়েছি সরাত জোরে/ পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই/ সে ছিল গাছের আড়েই/ ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার/ ধুমাধুম গোটা দুচ্চার/ দিলে খুব কিল ও ঘুষি/ একদম জোরসে ঠুসি/ আমিও বাগিয়ে থাপড়/ দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়/ লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল/ দেখি এক ভিটরে শেয়াল/ আরে ধ্যাত শেয়াল কোথা/ ভেলোটা দাঁড়িয়ে হোথা/ দেখে যেই আঁতকে ওঠা/ কুকুরও জুড়লে ছোটা/ আমি কই কম্ম কাবার/ কুকুরেই করবে সাবাড়/ ‘বাবা গো মা গো’ বলে/ পাঁচিলের ফোঁকল গলে/ ঢুকি গ্যে বোসদের ঘরে/ যেন প্রাণ আসল ধড়ে/ যাব ফের? কান মলি ভাই/ চুরিতে আর যদি যাই/ তবে মোর নামই মিছা/ কুকুরের চামড়া খিঁচা/ সে কি ভাই যায় রে ভোলা/ মালির ঐ পিটুনিগুলা/ কি বলিস ফের হপ্তা/ তৌবা-নাক খপ্তা।’
বাবু-হাবুদের কথা বাদ দিন। মনে করুন এক শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল যেখানে তিনি নবীন কর্মকর্তাদের দেখাচ্ছিলেন যে কীভাবে ছুরি-চামচ দিয়ে আহার সারতে হয়। পরে তিনি এমপি হয়েছিলেন। ৫ আগস্টের পর লাপাত্তা।
তিনি যে কমিশনের মাধ্যমে এমপি হয়েছিলেন তার একজন কমিশনার ছিলেন কবিতা খানম। ওই কমিশন নিশিভোট এবং ডামিভোটের অনেক মহাকাব্য রচনা করে গেছে। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা থাকলেও কবিতা খানম কবিতার মতো করে বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা মানে কোট প্যান্ট পরা না, দায়িত্ব পালন করা একমাত্র কাজ।’
তিনি এটাও বলেছিলেন, ‘আমরা সরকারের চাকর। জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য সরকার চেয়ার দিয়েছে। তাই সরকারের দায়িত্ব পালন একমাত্র কাজ।’
জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য সরকার তাদের চাকর হিসেবে নিয়োজিত করেছিল বলে তারা সেই চাকরের কাজই করে গেছেন। জনগণকে সেবা দেওয়া তো দূরের কথা, জনগণকে ভোটাধিকার থেকেই বঞ্চিত করেছিলেন!
তিনি না পারুন, কেউ কেউ পারে। যেমনটা ঘটেছে শরীয়তপুরে।
সেখানে জনসেবায় নিয়োজিত ডিসি এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা ভিডিওতে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বলছেন এটি বাস্তব, কেউ বলছেন নেটফ্লিক্স ওরিজিন্যাল। ভিডিওটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৫৭ সেকেন্ড, কিন্তু অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদি।
জেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডিসি মহোদয় যিনি জনগণের অভিভাবক, প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধি, তিনি ধরা পড়েছেন এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। কে তুলেছে, কেন তুলেছে, কীভাবে ভাইরাল হলো– এসব নিয়ে প্রশাসনে এখন টানটান রহস্য। তার চেয়ে বেশি উত্তেজনা নেট দুনিয়োয়।
তবে ভিডিওর চেয়ে বড় রহস্য, ডিসি এখন কোথায়? তার দপ্তরের একজন বলেলছেন, তিনি ক্যাম্পে গেছেন।
ক্যাম্প? কোন ক্যাম্প? ভোট ক্যাম্প, বন ক্যাম্প, না ক্যামেরা ক্যাম্প? কেউ জানে না, কেউ জানে না।
এমন কাণ্ড এটাই প্রথম নয়। রাষ্ট্রের ওই সেবকদের অদ্ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড বহুদিন ধরেই দেশজুড়ে আলোচনার খোরাক।

জামালপুরে সিসি ক্যামেরা ধারণ করে ফেলেছিল এক ডিসির রোম্যান্স দৃশ্য। সাহেবের রুমে ছিলেন এক নারী সহকর্মী। ভিডিও ভাইরাল এবং শরীয়তপুরের মতো তখন জামালপুরের ডিসিও নিখোঁজ! বলা হচ্ছিল, তিনি অফিসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কিন্তু অনেকের দাবি যে ভিডিওর ভাষা বলছে, তিনি নতুন কোনো নীতিমালা চর্চায় ব্যস্ত ছিলেন!
ডিসিদের অধঃস্তন কেউ কেউ আবার অন্যরকম ঘটনার জন্মদাত্রী।
একবার বগুড়ার আদমদিঘীতে এক ছাগল অফিস চত্বরে ঢুকে গাছ চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিল। ইউএনও ম্যাডাম তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ছাগলের মালিককে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। ছাগল নীরব ছিল, আত্মপক্ষ সমর্থন করেনি; অপরাধ স্বীকারও করেনি। তারপরও তাকে দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা আদায়! জনগণের অবশ্য মনে হয়েছির: রুল অব ল এখানে রুল অব গোট হয়েছে।
গোট বললে অবশ্য ছাগলকাণ্ডের মতিউরের কথা মনে হয়। তিনি আরো বড় কর্মকর্তা। বড়দের নিয়ে আরেকদিন কথা হতে পারে। আজ আবার মাঠের কর্মকর্তাদের প্রসঙ্গ।
কুড়িগ্রামে এক সাংবাদিককে রাত ২টায় জানালা ভেঙে ধরে আনা হয় ডিসি অফিসে। অপরাধ? একটি অনাকাঙ্ক্ষিত রিপোর্ট। তাকে ‘জরুরি প্রক্রিয়ায়’ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দেওয়া হলো একরাতের জেল। সাংবাদিকের জবানবন্দি, ‘আমি রিপোর্ট লিখি, তারা আমাকে রিপোর্ট করে ফেলে!’
যশোরে এক প্রতিবন্ধী সেবাগ্রহীতা ডিসি অফিসে গিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান। এক পর্যায়ে তিনি একজনকে কামড়ে দেন, আরেকজনকে আঘাত করেন স্ক্র্যাচ দিয়ে । ফলাফল? পুলিশ এসে উদ্ধার করে। তবে শিক্ষার্থীদের যারা প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, তারা নিজেরাই আটকে যায়।
অপরদিকে পাতারহাট কলেজের অধ্যক্ষ সাহেব একদম খোলামেলা বলেই ফেলেছেন, ‘ডিসি, ইউএনও, এডিসিকে সম্মানী দিতে হয়। ফি না নিলে সম্মান পাঠাব কেমনে?’ এই বক্তব্যে জনগণ বিস্মিত, সরকার বিব্রত, আর শিক্ষার্থীরা এখন ‘সম্মানী-সংক্রান্ত অর্থনীতি’ পড়তে বাধ্য।
করোনা মহামারির সময়ও সম্মানীর বিষয়-আশয় ঘটেছে। অফিস বন্ধ থাকলেও ডিসি-ইউএনও অফিসে চা-কফি-বিরিয়ানির বিল হয়েছে ঠিকই। অফিসে দর্শনার্থী ঢুকেনি, কিন্তু কাগজে খাসির মাংস গেছে তিন প্লেট!
জনগণ হাসছে, প্রশাসন গম্ভীর, হিসাবরক্ষক বলছেন, সব হয়েছে বাজেট মোতাবেক।
এমন বাস্তবতায় গত সম্মেলনের আগে ডিসিরা আরও ক্ষমতা চেয়েছিলেন। ভোটকেন্দ্র স্থাপন, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন; সবকিছু নিজের হাতে রাখতে চান তারা।
অথচ দেশের নির্বাচন কমিশন মনে করছে, ডিসি-ইউএনওকে অনেক কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার সময় এসেছে। আগের তিন-তিনটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ত সকলের চোখের সামনে।
_____________
ডিসক্লেইমার: উপরের রচনার প্রতিটি ঘটনা বাস্তব সংবাদ-সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হলেও কৌতুক ও ব্যঙ্গধর্মী শৈলীতে রচিত। উদ্দেশ্য কেবল নাগরিক সচেতনতা আর খানিকটা হাসির আয়োজন, কারো নিন্দা নয়।