ব্রিকস সম্মেলন শুরু ব্রাজিলে, এজেন্ডায় শুল্ক ও মধ্যপ্রাচ্য সংকট

টাইমস রিপোর্ট
4 Min Read
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা (ডানে) রিও দে জেনেইরোতে ১৭তম বার্ষিক ব্রিকস সম্মেলনের আগে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং-এর সঙ্গে করমর্দন করছেন। ছবি: এপি/ইউএনবি।

উন্নয়নশীল অর্থনীতির জোট ব্রিকস-এর দুদিনব্যাপী সম্মেলন ব্রাজিলে শুরু হয়েছে। এ সম্মেলনে ইরানে ইসরায়েলের হামলা, গাজায় মানবিক সংকট এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত বাণিজ্য শুল্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করার কথা রয়েছে। সোমবার এ সম্মেলন শেষ হবে।

বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলছেন, ২০২৪ সালে আকারে দ্বিগুণ হওয়া বৃহত্তর ব্রিকস জোটের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকায় বিশ্ব রাজনীতিতে এটি আরেকটি শক্তিশালী মেরুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তারা মনে করছেন, এবারের সম্মেলনের সংযত ও মাঝারি কর্মসূচি মূলত সদস্য দেশগুলোর ট্রাম্প প্রশাসনের নজর এড়ানোর একটি কৌশল।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সম্মেলনে তার অগ্রাধিকার হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়েছেন, যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশ্বনেতা সম্মেলনে অনুপস্থিত রয়েছেন।

রোববার লুলা তার ভাষণে বলেন, ‘আমরা বহুপাক্ষিকতার অভূতপূর্ব পতনের সাক্ষী হচ্ছি এবং এটাই ব্রাজিলের আয়োজিত চারটি ব্রিকস সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিকূল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট।’ তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংকট নিরসনে ব্রিকসের ভূমিকা বাড়ানোর আহ্বান জানান।

‘আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা যদি ২১শ শতাব্দীর নতুন বহুমুখী বাস্তবতার প্রতিফলন না হয়, তবে ব্রিকসের দায়িত্ব এটি সংস্কারে অবদান রাখা,’ যোগ করেন তিনি।

প্রথমবারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্রিকস সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হবেন। কারণ, ইউক্রেন আক্রমণের পর তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় তিনি বিদেশ ভ্রমণ এড়িয়ে চলছেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল-ফাত্তাহ আল-সিসিও রিও ডি জেনেইরোতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে উপস্থিত হননি।

তিনটি যৌথ বিবৃতির প্রত্যাশা

রিও ডি জেনেইরোর এই সংযত সম্মেলন ২০২৪ সালে রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলন থেকে অনেকটাই আলাদা। সেবার ক্রেমলিন মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত পেমেন্ট সিস্টেমের বিকল্প গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল, যাতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যায়।

শুক্রবার এক আলোচনারত সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, গাজা ও ইসরায়েলের ইরানে হামলার বিষয়ে কিছু সদস্য দেশ আরও কড়া ভাষার বিবৃতি চাইছে। তবে এই ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন, তারা গণমাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলার অনুমতি পাননি।

গেটুলিও ভারগাস ফাউন্ডেশনের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের শিক্ষক অলিভার স্টুয়েনকেল বলেন, ‘ব্রাজিল চাইছে সম্মেলনটি যতটা সম্ভব টেকনিক্যাল ও নিরপেক্ষ রাখতে।’

ফলে, পর্যবেক্ষকদের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিয়ে সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র হবে অত্যন্ত অস্পষ্ট। স্টুয়েনকেল বলেন, পুতিন ও শির অনুপস্থিতির কারণে একটি সফট ও বিতর্কহীন বিবৃতি দেওয়া ব্রাজিলের জন্য আরও সহজ হবে। রাশিয়া ও চীন যেখানে পশ্চিমবিরোধী শক্তিশালী অবস্থান নিতে চায়, সেখানে ব্রাজিল ও ভারত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেই আগ্রহী।

পন্টিফিক্যাল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব পারানার আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ক শিক্ষক অধ্যাপক জোয়াও আলফ্রেডো নাইগ্রে বলেন, ‘এই সম্মেলন বিশ্বে একটি বিকল্প নেতৃত্ব দেখানোর সুযোগ পেতে পারত, কিন্তু সেটা হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসির অংশগ্রহণ প্রত্যাহার এবং ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধি স্তর নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখাচ্ছে যে ব্রিকসের পক্ষে বৈশ্বিক নেতৃত্বের একটি সংহত মেরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। এই মুহূর্তে উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবে আমরা ছড়িয়ে পড়া অবস্থাই দেখছি।’

ট্রাম্পের শুল্ক এড়াতে চায় ব্রাজিল

ব্রাজিল এবারের ব্রিকস সম্মেলনের সভাপতিত্ব করছে। ছয়টি কৌশলগত অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সহযোগিতা; বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থ; জলবায়ু পরিবর্তন; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শাসনব্যবস্থা; শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন।

রিও ডি জেনেইরো ফেডারেল রুরাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আনা গার্সিয়া বলেন, ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফেরার পর, ব্রাজিল বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের মতো কম সংবেদনশীল ইস্যুতে মনোযোগ দিতে চায়।

তিনি বলেন, ‘ব্রাজিল চায় সম্মেলনে যেন সর্বনিম্ন ঝুঁকি থাকে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টি যেন ব্রাজিলের অর্থনীতির উপর না পড়ে।’

রোববার ব্রাজিল পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের পক্ষে কথা বললেও, দেশটি চায় না যেন সে ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত ব্রাজিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের শুল্কের ঝুঁকি এড়াতে পেরেছে। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যদি ব্রিকস দেশগুলো ডলারের প্রভাব খর্ব করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়, তবে তিনি ব্লকের পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *