শিশুমৃত্যু হার হ্রাস ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বায়ুদূষণ ও পরিবেশজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম—ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) সর্বশেষ গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ (জিবিডি) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জাপান, নরওয়ে এবং সুইজারল্যান্ড যখন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশগত স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ুতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব বজায় রাখছে, তখন বাংলাদেশ অবস্থান করছে একটি ‘রূপান্তরকালীন ধাপে’- যেখানে কিছু খাতে অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও অন্য ক্ষেত্রে রয়ে গেছে মারাত্মক ঘাটতি, বলেছে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের মেডিকেল স্কুল-সংশ্লিষ্ট এই প্রতিষ্ঠানটি।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে হ্রাস করা। টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ, পুষ্টি উন্নয়ন এবং প্রসূতি সেবায় বিনিয়োগের কারণে ১৯৯০-এর দশকে যেখানে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুহার ছিল ১০০-এর ওপরে, এখন তা কমে এসেছে ৩০–৩৫-এ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চাদ ও দক্ষিণ সুদানের মতো সাব-সাহারান আফ্রিকার কিছু দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে, যেখানে এখনও প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুহার ১০০-এর ওপরে।’
তবে এই অগ্রগতিকে ম্লান করে দিচ্ছে দেশের ক্রমাগত খারাপ হওয়া বায়ুমান।
বিশ্বে সর্বোচ্চ পরিমাণ সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম২.৫) ঘনত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয়, কেবল চাদের পরে। তথ্য অনুযায়ী, দেশের গড় বায়ুমান সূচক (একিউআই) প্রায় ১৬৭, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১৫-এর নিচে সূচককে নিরাপদ হিসেবে গণ্য করে। এই পরিবেশগত সংকট শিশুদের মাঝে শ্বাসতন্ত্র রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।

আইএইচএমই-এর হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের নিচের বয়সী ১৯ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু বায়ুদূষণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে কেবল ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের আগে।
গৃহস্থালির বায়ুদূষণ- বিশেষ করে কাঠ, গবাদিপশুর গোবর ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে রান্না- এই মৃত্যুহারের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে এখনো পরিষ্কার জ্বালানির অভাব, সেখানে শিশুরা ঘরের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এসে নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্র সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় এই ধরনের পরিস্থিতি নবজাতক মৃত্যুর অন্তত এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী।
অন্যদিকে, নিউজিল্যান্ড ও বাহামাসের মতো শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোতে পিএম২.৫ মাত্রা ১০-এর নিচে, যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ বায়ু হিসেবে ধরা হয়। অপরদিকে, বাংলাদেশ এখন এমন দেশগুলোর কাতারে রয়েছে, যারা দীর্ঘমেয়াদি সংকট ও পরিবেশগত ধ্বংসের মধ্যে রয়েছে। তবুও, মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা, টিকার কভারেজ ও রোগ নজরদারির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও আফ্রিকার কিছু নিম্ন র্যাংকপ্রাপ্ত দেশের চেয়ে ভালো করছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, দূষণ রোধ ও শ্বাসতন্ত্র স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত অগ্রগতি থেমে যেতে পারে বা উল্টোদিকে ঘুরে যেতে পারে। নীতিগত সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরিষ্কার জ্বালানিতে রূপান্তর, যানবাহন ও কারখানার ওপর কঠোর নির্গমন নিয়ন্ত্রণ এবং অনুন্নত এলাকায় অ্যান্টিবায়োটিক ও নিউমোনিয়া টিকার বিস্তৃতি।
প্রতিবেদনের মন্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি একটি জটিল বাস্তবতা নির্দেশ করে- একটি দেশ, যারা অতীতে শিশু মৃত্যুর হার ও সংক্রামক রোগ দমনে সাফল্য পেয়েছে, এখন নতুন ধরনের পরিবেশগত ও নগরায়ণ-সম্পর্কিত হুমকির মুখোমুখি।
সার্বিকভাবে, বিশ্বের শীর্ষ স্বাস্থ্যকর দেশের সঙ্গে ব্যবধান কমাতে হলে বাংলাদেশকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোগত ও পরিবেশগত উপাদানগুলোর প্রতি ততটাই গুরুত্ব দিতে হবে, যতটা গুরুত্ব একসময় শিশুমৃত্যু কমাতে দেওয়া হয়েছিল- বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।