ক্ষমতার গোপন করিডোর, যেখানে গোপনীয়তা জাতিগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করে। এমন দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অন্যতম কৌশল হল ‘নীরবতা’। এই গোপন পৃথিবীতে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে একসময় প্রান্তিক ভূমিকায় থাকা নারীরা এখন বিশ্বমানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ অধিকর্তা।
২০২৫ সালে এসে বিশ্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রহস্যময় করিডোরগুলোতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এমন একজন তুলসী গ্যাবার্ড। ওয়াশিংটন ডিসিতে, ট্রাম্প প্রশাসনে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। যার নিয়োগ ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। সাবেক এ কংগ্রেস সদস্য নিজের সামরিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মিশেলে মার্কিন গোয়েন্দা ব্যবস্থার বিশাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন।

ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্পের পূর্বসূরী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনেও জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন একজন নারী- অ্যাভরিল হেইনস।
আটলান্টিক পেরিয়ে যুক্তরাজ্যেও এমন নজির তৈরি হয়েছে। সেখানে কিংবদন্তিতুল্য গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬–এর প্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো নিযুক্ত হয়েছেন একজন নারী, ব্লেইজ মেট্রেউয়েলি।
এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাজ্য, যা হয়ত জেমস বন্ডও কল্পনা করেননি! প্রথমবারের মতো এমআই৬, এমআই৫ ও জিসিএইচকিউ- তিনটি প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষপদেই রয়েছেন নারীরা।
তবে এই উত্থান ২০২৫ সালে শুরু হয়নি।
২০২৩ সালে, অ্যান কিস্ট-বাটলার প্রথম নারী হিসেবে নিযুক্ত হন জিসিএইচকিউ’র পরিচালক হিসেবে- যা সিগন্যাল এবং সাইবার গোয়েন্দার দপ্তর।
এমনকি জুডি ডেঞ্চ যখন জেমস বন্ডের ‘গোল্ডেন আই’ সিনেমায় এমআই৬ প্রধানের ভূমিকায় অভিনয় করেন, তার তিন বছর আগেই বাস্তব জীবনে স্টেলা রিমিংটন এমআই৫–এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৯২ সালে যোগদিয়ে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সংস্থাটি পরিচালনা করেন।
২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এমআই৫ পরিচালনা করেন আরেক নারী, এলিজা ম্যানিংহ্যাম-বুলার।
ব্লেইজ মেট্রেউয়েলিকে এমআই৬–এর ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান হিসেবে নিয়োগের মধ্যদিয়ে তিনটি সংস্থারই সর্বোচ্চ পদে নারীর অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হল।

ছবি: সংগৃহীত
মেট্রেউয়েলি ১৯৯৯ সালে এমআই৬–এ যোগ দেওয়ার আগে কর্মজীবন শুরু করেন এমআই৫–এ। সম্প্রতি তিনি টেকনোলজি বিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন। তার এ নিয়োগ প্রগতিশীল ও প্রযুক্তি-ভিত্তিক নেতৃত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন ডিজিটাল যুদ্ধ ও এআই–ভিত্তিক গোয়েন্দাবৃত্তি আধুনিক বিশ্বে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এই শরৎ-এ, তিনি গ্রহণ করবেন এমআই৬–এর প্রধানের ঐতিহাসিক পদ ‘‘সি’’। যা একসময় শুধুই পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ধোঁয়ায় ভরা কক্ষে বসা পুরুষ কর্তাদের একচেটিয়া ক্ষমতার প্রতীক ছিল চেয়ারটি।
এই প্রবণতা কেবল যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়।

ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে, অ্যাভরিল হেইনস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে প্রথম নারী হিসেবে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। জিনা হ্যাসপেল ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সিআইএ–এর প্রধান ছিলেন। যিনি প্রথম নারী হিসেবে বিশ্বখ্যাত এই গোয়েন্দা সংস্থার নেতৃত্ব দেন।
অস্ট্রেলিয়াতেও কেরি হার্টল্যান্ড এখন এএসআইএস–এর (অস্ট্রেলিয়ান সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এই নামগুলো নিছক নজির নয়—এগুলো একটি দীর্ঘ ঐতিহ্যের ফল, যেখানে ছিল ঝুঁকি, দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের ইতিহাস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে বহু নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে।
নূর ইনায়েত খান, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ এসওই এজেন্ট, দখলকৃত ফ্রান্স থেকে তথ্য পাঠাতেন। তাকে নাৎসিরা ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করলেও তিনি একটি গোপন তথ্যও ফাঁস করেননি।

ছবি: উইকিমিডিয়া
ভায়োলেট সাবো, শুধু সাহস ও একটি স্টেনগান নিয়ে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক মিশনে অংশ নেন। সাহসিকতার সঙ্গে তার মৃত্যু হয়।
আমেরিকান গুপ্তচর ভার্জিনিয়া হল দীর্ঘদিন ধরে একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। কৃত্রিম পা ও অদম্য মনোবল নিয়ে তিনি ফরাসি প্রতিরোধ সেল সংগঠিত করেন। অত্যন্ত নিখুঁততার সঙ্গে নাৎসি জার্মানির গোপন পুলিশ বাহিনীকে (গেস্টাপো) ফাঁকি দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাকে ‘ইউরোপের সবচেয়ে বিপজ্জনক নারী’ বলে অভিহিত করেন।
প্রতিপক্ষের পক্ষেও ছিল এমন নারীর উপস্থিতি।

ছবি: সংগৃহীত
মেলিটা নরউড, এক ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারী। তিনি আজীবন কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে গেছেন। চার দশক ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক গোপন তথ্য পাচার করেছিলেন তিনি। বার্ধক্যে এসে তার পরিচয় ফাঁস হয়। তাকে কখনও জেলে যেতে হয়নি। তিনি ছিলেন শীতল যুদ্ধের ছায়ায় ঘুরে বেড়ানো এক ভূত।
আজকের গোয়েন্দা বিশ্ব আর ট্রেঞ্চ কোট ও ট্যাপড ফোনের খেলা নয়। সাইবার যুদ্ধ, ভুয়া তথ্য ছড়ানো, এআই–ভিত্তিক নজরদারি এবং বিপথগামী রাষ্ট্রসমূহ এই যুদ্ধক্ষেত্রকে নতুন রূপ দিয়েছে। এই নতুন বাস্তবতায় কেবল প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয়, চাই কৌশলী নেতৃত্ব ও মনস্তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা-যা নারীরা এখন প্রমাণ করছেন।
তবুও, চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এই ছায়াময় জগতে এখনো নারী-পুরুষের সমতা অর্জিত হয়নি।
অপারেশনাল ইউনিট, কৌশলগত নেতৃত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা নীতিনির্ধারণী পদগুলো এখনো পুরুষপ্রধান। কিন্তু গ্যাবার্ড, মেট্রেউয়েলি, কিস্ট-বাটলার এবং তাদের সহযাত্রীদের উত্থান একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—যেখানে বৈশ্বিক গোয়েন্দা দুনিয়ার গেটকিপাররা বদলে যাচ্ছেন।