মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘদিনের সহিংসতা এখন নতুন মাত্রা নিতে পারে। রাখাইনে কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের মার্কিন পরিকল্পনা রয়েছে বলে বিভিন্ন নিরাপত্তা বিশ্লেষণী সংস্থা দাবি করছে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার মধ্যে রয়েছে, সেখানে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বায়ত্ত্বশাসিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
এ প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে যে জটিল ভূ-রাজনীতি দেখা দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, এ প্রশ্নও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক বিশ্লেষক মাইকেল মার্টিনসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ বলছে, আরাকান, কাচিন এবং কারেনি– মিয়ানমারের এই তিন সীমান্ত রাজ্যে স্বঘোষিত ‘জনতার সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমা শক্তি নীরবে এই নতুন বন্দোবস্তকে সমর্থন দিচ্ছে। এর নেপথ্য কারণ দু’টি– এক. মিয়ামারের সামরিক জান্তাকে দুর্বল করা ও দুই. রাজনৈতিক শক্তিকে বিভক্ত করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ করে তোলা।
মাইকেল মার্টিন বলেন, ‘মিয়ানমারে সামরিক প্রশাসনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার ফলে দেশটির অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে ওয়াশিংটনের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে থেকে উত্তরণে তার পরামর্শ, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গঠনে কারিগরি সহায়তা দেওয়া। যা একদিকে মানবিক সহায়তা হিসেবে কাজ করবে, অন্যদিকে কৌশলগত সুবিধাও এনে দেবে।’
কিন্তু রাখাইন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া কি বাংলাদেশের জন্য উচিৎ হবে? নোপিডোর সঙ্গে ঢাকার দীর্ঘদিনের অবস্থান সতর্ক নিরপেক্ষতার। যা এখন আরও স্পষ্ট করার দাবি রাখে– এমনটাই মনে করেন অনেকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক বলেন, ‘রাখাইনকে যদি প্রক্সি যুদ্ধের মঞ্চ হিসেবে ধরা হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেখানে জড়ানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহ ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।’
টাইমস অব বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে এবং কৌশলগত অভিযানে না গিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
বলা ভাল, রাখাইন কেবল নাফ নদীর ওপারের যুদ্ধ ক্ষেত্র নয়—এটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, শরণার্থী ও দেশহীন গণমানুষের আর্তনাদ। ইতোমধ্যেই প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, যা মানবিক দায়বদ্ধতার মাত্রা ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছে এ দেশের কূটনৈতিক ও জনমিতিক সংকটে।
ইতিহাস সমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্যের ভৌগলিক অবস্থান যে কোনো বড় শক্তির নজর কাড়বে। এটি চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও বঙ্গোপসাগর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত তেল ও গ্যাস পাইপলাইন—সবই রাখাইন রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
চীনের জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায় রাখাইনে নতুন কোনো রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চীনের জন্য সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য সরাসরি একটি হুমকি।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত নয়া পরিকল্পনায় ভারতও উদ্বিগ্ন। ভারতের পূর্ব সীমান্তে ধর্মভিত্তিক কোনো স্বায়ত্ত্বশাসিত রাষ্ট্র গড়ে উঠলে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাতিগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল—যেমন নাগাল্যান্ড, মনিপুর ও মিজোরামে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা শক্তিশালী হতে পারে– এমন আশঙ্কা করছেন ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
কাজেই রাখাইন প্রক্সি-যুদ্ধে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলা মানেই কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে অস্থিরতা ডেকে আনা। যা একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও উস্কে দিতে পারে।
মিয়ানমার প্রশ্নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে তাই নিরপেক্ষতা নয়, বরং চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশলে যেতে হবে। প্রয়োজন পড়বে জোটবদ্ধ না হওয়ার কৌশলগত অবস্থান নীতি, যা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় হবে দ্বিধাহীন।