বাংলাদেশে কেন নেই কামিন্দু-থারিন্দুর মতো সব্যসাচীরা?

টাইমস স্পোর্টস
8 Min Read
শ্রীলংকার দুই সব্যসাচী স্পিনার কামিন্দু মেন্ডিস ও থারিন্দু রথনায়েকে (নিচে)। ছবি: সংগৃহীত

ভিন্ন, অদ্ভূত বোলিং অ্যাকশনের অনেক বোলারই আছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু স্পিনার কিংবা পেসার মিলিয়ে শ্রীলংকায় এর যে প্রাচুর্য, তেমনটা আর কোনো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে দেখা যায়নি। কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরন থেকে শুরু করে লাসিথ মালিঙ্গা, আধুনিক যুগের মাথিশা পাথিরানা কিংবা নুয়ান থুসারা; কেউই ঠিক প্রথাগত অ্যাকশনের বোলার নন। ভিন্নতার এই প্রাচুর্যে এখন আলো কাড়ছেন শ্রীলংকার দুই সব্যসাচী স্পিনার কামিন্দু মেন্ডিস ও থারিন্দু রথনায়েকে। যারা দুই হাতেই বল করতে পারেন সমানতালে। 

অবশ্য শ্রীলংকার সব্যসাচী স্পিনারদের তালিকা করলে সবার আগে আসবে সাবেক ক্রিকেটার হাশান তিলকারত্নের নাম। বাংলাদেশ নারী দলের সাবেক এই কোচ, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের শেষ ওভারে বল করেছিলেন দুই হাত মিলিয়ে। এরপর দীর্ঘদিন সব্যসাচী স্পিনার দেখা যায়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি এমন সব্যসাচী স্পিনার আছেন? থাকলেও কেন তারা আলোচনায় উঠে আসেন না? 

প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল তিনটি নাম, তরুণ রায়ান রাফসান রহমান, হুসনে হাবিব মেহেদী ও জাতীয় নারী দলের সাবেক ক্রিকেটার শায়লা শারমিন। ব্যাটিং অলরাউন্ডার রাফসান এখনো খেলছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। মেহেদীও খুব নিয়মিত পারফর্মার নন। আর শায়লা সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২০১৯ সালে। 

২৭ বছর বয়সী রাফসান ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের সর্বশেষ মৌসুমে অধিনায়কত্ব করেছেন শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। ব্যাটিং অলরাউন্ডার হলেও পার্ট টাইম অফস্পিন করেন। কিন্তু বল করতে পারেন বাম হাতেও। যার শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে কামিন্দু মেন্ডিসকে দেখে। 

ব্যাটিং অলরাউন্ডার হলেও দুই হাতেই স্পিন করতে পারেন রায়ান রাফসান রহমান। ছবি: রায়ান রাফসান

নারায়নগঞ্জের ছেলে রাফসানের কোচ সাবেক ক্রিকেটার জাহাঙ্গীর আলম। শুরুতে দুই হাতে বল করতে গিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও টানা দুই বছরের অনুশীলনে আয়ত্ত্বে আনতে পেরেছেন বাঁহাতি স্পিনটা।  কোচ জাহাঙ্গীর আলমের অনুপ্রেরণায় দুই হাতে বল করার গল্পটা রাফসান শোনালেন এভাবে, ‘আমার যে কোচ জাহাঙ্গীর আলম,বলেছিলেন করতে থাকো, একটা সময় গিয়ে সহজ হয় যাবে তোমার জন্য। এই জিনিসটাই দুই বছর করার পর আস্তে আস্তে হয়ে গিয়েছে।’

এমনিতে নেটে বল করলেও নারায়নগঞ্জের স্থানীয় এক লিগেই প্রথমবার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচে দুই হাতে বল করেছিলেন রাফসান, ‘এটা প্রথম আমি নারায়ানগঞ্জের লোকাল লিগ থেকে শুরু করেছিলাম। আমাদের লোকাল লিগে আবার খুব কম্পিটিটিভ ম্যাচ হয়। ডিপিএল, ফার্স্ট ডিভিশনের প্লেয়াররা এসে খেলেন। বাইরের যে প্লেয়াররা খেলতে আসেন, তাদের সামনে বল করলাম তখন আমার কনফিডেন্স বুস্ট আপ হলো।’

কিন্তু তার মতো স্পিনাররা কেন উঠে আসতে পারছেন না ধাপ পেরিয়ে? বিসিবির সাবেক নির্বাচক ও অনূর্ধ্ব-১৭ দলের কোচ হান্নান সরকারের মতে, চোখের সামনে আদর্শ মানার মতো ব্যতিক্রমী ক্রিকেটার না থাকাটা এর অন্যতম কারণ। শ্রীলংকায় মালিঙ্গার পর যেমন পাথিরানা বা থুসারার মতো পেসার এসেছেন, একসাথে খেলছেন কামিন্দু মেন্ডিস-থারিন্দু রথনায়েকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হান্নান সরকার এই জায়গাতে ঘাটতি দেখেন। 

বাংলাদেশে কেন নেই এমন বোলার, এই প্রশ্নের উত্তরে টাইমস অফ বাংলাদেশকে হান্নান বলেন, ‘এটার কোনো লজিক আসলে আমি চিন্তা করে পাইনি। বেসিক্যালি,ছোটবেলা থেকে হয় না অনেকে মজা করে বল করে দুই হাতে। কিন্তু এই জিনিসটা বেশ রেয়ার। এটা না হওয়ার স্পেসিফিক কারণ সেভাবে বলা কঠিন। তবে হয় কি, মানুষ যখন চোখের সামনে যখন কোনো আইডল দেখে, সবাই তখন তাকে ফলো করার চেষ্টা করে। 

‘বিশ্ব ক্রিকেটে এটা ওরকমভাবে এখনো পরিচিত না। কিন্তু যখন আরো পরিচিতি পাবে, যখনই এরকম হবে বাচ্চারা দুষ্টুমির ছলে হোক, খেলার ছলে হোক, আস্তে আস্তে জিনিসগুলো এস্টাবলিশড হওয়া শুরু করে।  শ্রীলংকায় এই বিষয়টা যখন দেখল সবাই, অনেকেই হয়তো মজা করে ছোটবেলায় শুরু করে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে করতে করতেই জিনিসটা হয়। এমন না যে বড় হওয়ার পরে শুরু করেছে। ন্যাচারালি আসতে হয় এসব।’, যোগ করেন বাংলাদেশের সাবেক এই ক্রিকেটার। 

একই প্রশ্নে আরেক সাবেক ক্রিকেটার ও হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি) ব্যাটিং কোচ রাজিন সালেহ বলেছেন তৃণমূল থেকে ক্রিকেটার তুলে আনার কথা। তার মতে আগের মতো স্পিনার-পেসার হান্ট চালু হলে, ব্যতিক্রমী বোলারদের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসার সুযোগ থাকবে। 

রাজিন বলেন, ‘প্রথমত,আগে আমাদের স্পিন হান্ট হতো, পেসার হান্ট হতো। এসব হান্ট কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে। আবার যদি স্পিনার হান্ট চালু হয়, যেখান থেকে র ট্যালেন্ট উঠে আসবে। এমন অনেকেই আছে যারা ক্রিকেট সম্পর্কে জানে কম, কিন্তু ট্যালেন্ট আছে। অনেকে আছে যারা সুযোগ পাচ্ছে না উঠে আসার। এসব ব্যতিক্রমী যেসব ট্যালেন্ট উঠে আসতে পারে, যদি স্পিন হান্টটা আবার চালু করা যায়।’ 

দুই হাতে বল করতে পারা রাফসান ব্যতিক্রমী অ্যাকশনের বোলারদের উঠে না আসার নেপথ্যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন দেশের তৃণমূল ক্রিকেটের সংস্কৃতিকে। নিয়মের বাইরে কেউ যেতে চায় না বলে খানিকটা অনুযোগের সুরেই বলেন, ‘আমাদের একটা কালচার আছে, সেটা থেকে বের হতে চায় না কেউ। সবকিছুরই বেসিকের মধ্যে থাকতে চায়। আমাদের অন্য টাইপের বোলার বের না হওয়ার অন্যতম কারণ, যার যেটা ন্যাচারাল সেটা না রেখে সবাই এবিসিডির মতো বেসিকে চলে যেতে চায়। ছোট থেকে হাতে ধরে একটা জিনিসই শেখায়, এভাবে বল করতে হয়।’

ব্যতিক্রমী বোলারদের শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে উঠে আসতে না পারার পেছনে তৃণমূল কিংবা বয়সভিত্তিক দলের কোচদের দায়ভার কতখানি? 

এ প্রসঙ্গে বিসিবির সাবেক নির্বাচক হান্নান সরকারের ব্যাখারও মিল পাওয়া গেল রাফসানের অভিযোগের সাথে। হান্নান জানান, বাংলাদেশের কোচিং মেথডে কিংবা তৃণমূল ক্রিকেটের সংস্কৃতিতে ব্যতিক্রমী জিনিসগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কোচদের কাছে কম। যেসব কারণে কেউ ভিন্নভাবে চিন্তা করলেও টিকে থাকার জন্য সেই ভাবনা থেকে সরে আসেন। 

বাংলাদেশের হয়ে ১৭টি টেস্ট ও ২০টি ওয়ানডে খেলা হান্নান বলেন,  ‘বর্তমানে সময়ে অনেকে বোলার যেকোনো একটায় এক্সপার্ট হয়। তখন আমাদের কোচিং সিস্টেম কিংবা কোচরা সাধারণত বলেন, তুমি যেটা ভালো পারো, সেটাতে আরো মাস্টার হও। তখন সেই ক্রিকেটারের ফোকাসটা কেবল একদিকেই থাকে। সেই নিবেদনটা আর তাদের থাকে না। এটাও একটা কারণ হতে পারে। আরেকটা হলো, শুরুর দিকে বাচ্চারা এমন কিছুর চিন্তা করলেও আমাদের কোচিং সিস্টেমে কোচরা এসব জিনিসকে খুব বেশি এপ্রিসিয়েট করে না। যার কারণে তার ঐ স্কিলটা আর ডেভেলপ করে না।

বয়সভিত্তিক দল কিংবা জুনিয়র লেভেলের কোচরা ব্যতিক্রমী কিছু গ্রহণ করতে চান না বলে মত দিয়েছেন ২৪ টেস্ট আর ৪৩ ওয়ানডে খেলা সাবেক ডানহাতি ব্যাটার রাজিন সালেহ। তার চাওয়া জুনিয়র লেভেলের ক্রিকেটে এমন সব ব্যতিক্রমী ক্রিকেটারদের আরো সুযোগ দেয়া, যত বেশি সম্ভব ম্যাচ খেলানো। 

রাজিন বলেন, ‘লোকাল কোচরা আসলে কে কেমন সেটা জানা নেই। তবে এই ব্যাপারে আমি একমত। উদাহরণ হিসেবে বলি, যদি সিলেট বিভাগীয় দল বা জেলা দল থেকে কেউ ব্যতিক্রমী কিছু করতে চায়, তাকে সেই সুযোগটা দেয়া হয় না। হয়তো সেই ছেলেটা তখন ভালোভাবে বল করতে পারছে না কোনো কারণে। কিন্তু এরপর সুযোগ না পেয়ে ছেলেটা ডিমোরালাইজড হয়ে যায়।’

এসব ক্ষেত্রে বিসিবি ও গেম ডেভেলপমেন্টের হস্তক্ষেপ ও নজরদারির সুযোগ আছে বলে মনে করেন রাজিন, ‘জুনিয়র লেভেলে আন্তঃজেলা ক্রিকেটে ম্যাচের পরিমাণ খুবই কম। দুই থেকে তিনটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। চারটা জেলা মিলে দেখা যায় তিনটা ম্যাচ হচ্ছে। খেলার সুযোগই থাকে কম। আমার মনে হয় জুনিয়র লেভেলে খেলার সুযোগটা বাড়ানো যায়, যদি সেই  ব্যতিক্রমী ট্যালেন্টেড বোলারটাকে খেলাতে বাধ্য করা হয় বোর্ড থেকে, তাহলে পাওয়াটা সহজ হবে।’

অবশ্য বাংলাদেশের সব্যসাচী বোলারদের বর্তমানের বাস্তবতার কঠিন চিত্রও ফুটে উঠেছে হান্নান সরকারের কথায়। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা রাফসান ও মেহেদীকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘যে দুজন খেলছে, তারা কিন্তু কেউই সেই অর্থে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার নন। ব্যাটিংয়ে যেমন রাফসান ঠিক আছে, বোলিংয়ে কিন্তু রেগুলার বোলার না। আর মেহেদীও খুব এস্টাবলিশড পারফর্মার না।’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *