ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সমাজসেবা সচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সীমা আক্তার। তার জীবনের গল্প শুরু হয়েছিল রাজধানীর মিরপুর এলাকায় কালশী নতুন রাস্তার এক পাশে বেগুনটিলা বস্তিতে। বিদ্যুৎ-পানি- পয়ঃনিস্কাশনের নাগরিক সুবিধাবিহীন ঘিঞ্জি ঝুপড়িতে শৈশবেই তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসর সৈনিক সেই সীমা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত প্রতিবাদী মুখ। ছাত্র অধিকার, নারী নিরাপত্তা বা ধর্ষণের বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো স্লোগান—সবখানে তিনি এক কদম এগিয়ে। জুলাইয়ের অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে টুকরো ইটের আঘাতে তাকে কয়েকটি দাঁত খোয়াতে হয়। তবে পরদিনই তিনি আবার ছুটের আসেন রাজপথের রণক্ষেত্রে।
‘সেদিন আমি মারা গেলে হয়তো দেশের উপকার হতো, কিন্তু বেঁচে থাকলেও কাজ করার সুযোগ আছে। শিক্ষার্থীরা যদি আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে আমাকে সমর্থন দেয়, আমি ক্যাম্পাসের পরিবেশ মানবিক করতে চাই,’ টাইমস অব বাংলাদেশকে অকপটে বলেন নেত্রী সীমা আক্তার।
তার কণ্ঠের দৃঢ়তা আরো স্পষ্ট হয় ফেলে আসা দিনগুলোর কথায়। ১৯৯৯ সালে জন্ম নেওয়া সীমা পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। অল্প বয়সেই অভাব তাকে দিয়েছিল দুরন্ত প্রাণশক্তি। তার তিন বড় বোন স্কুল ছেড়ে পোশাক কারখানায় কাজ করতে বিদেশে চলে যান, যা পরিবারকে কিছুটা সাহায্য করলেও লেখাপড়া করা তাদের আর হয়ে ওঠেনি।

তার বাবা গিয়াসউদ্দিন মির্জা চায়ের দোকান চালান, মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আত্মমর্যাদায় বাধে বলে কোনোদিন সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেননি। তার মা শাহিদা বেগম গৃহিনী, চায়ের দোকান ও সংসারের ঘানি টানছেন আজীবন।
সীমা মনে করেন, দীর্ঘ সময় ধরে পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা, নোংরা পুকুরে গোসল, ঝড়বৃষ্টির সময় খাটের নিচে রাত্রিযাপন, নারী ও শিশু পাচার চক্রের কাছ থেকে আত্মরক্ষা—এসবই তার জীবন চলার পথকে শানিত করেছে।
সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য ‘আমাদের পাঠশালা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবীদের স্কুল তার জীবন বদলে দেয়। এই স্কুলে বস্তিবাসী শিশুদের পড়ানো হয় যত্ন নিয়ে, দেওয়া হয় সাংস্কৃতিক শিক্ষাও। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে শিখিয়েছিলেন, সমাজে নারী হচ্ছেন সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষ, যিনি ঘরেবাইরে সর্বত্র ‘বৈষম্যের শিকার’।
‘পাঠশালাতে’ পড়ার সময়ই ছোট্ট সীমার মনে প্রশ্ন জাগে, সামাজিক বৈষম্য নিয়ে। আচ্ছা, মিরপুরের অনেক রাস্তাই তো পাকা, আর তাদের কালশীর বেগুনটিলা বস্তি এলাকার রাস্তগুলো কাঁচা কেন? সব সুবিধা কী শুধু ‘বড়লোকদের’ জন্য?
অভাবে কারণে বার বার হোঁচট খেয়েছেন সীমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগে পড়তে এসেও তীক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। বাদ্যযন্ত্র কিনতে না পারায় এক শিক্ষক তাকে এমন কথাও বলেছেন, ‘তুমি কী রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াবে?’
ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করে ২০২৩ সালে বাবা যেদিন চলে যান, তার পরিবার আরও বেশি কষ্টে পড়ে।
এসবই তার চেতনাকে আরো শানিত করেছে, গোর্কির পাঠে নিজেকে শিক্ষিত করেছেন সীমা। ছাত্র ফেডারেশন তাকে শিখিয়েছে, সমমর্যাদা, সাম্য আর ন্যায় বিচারের আদর্শে সমাজ গড়ার লড়াই।
এখন ডাকসু নির্বাচনে তার প্রার্থীতা ছাত্র সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ আরো বাড়িয়েছে।
‘আমি শিক্ষায় বৈষম্যহীনতার বিরুদ্ধে লড়তে চাই, এই ক্যাম্পাসকে মানবিক বানাতে চাই– ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, এমনকি টিএসসির রিকশাওয়ালার জন্যও প্রতিষ্ঠা করতে চাই অধিকার। আমার সংগ্রাম সবার স্বার্থ রক্ষার’, বলেন সীমা আক্তার।