সালটা ১৯১৪। ১০ ফেব্রুয়ারি। কলকাতার শান্তিনিকেতনে তখন দুপুর। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য পৃথিবীর আড়াল হয় হয় করছে। ওই ক্ষণে পিলু-ভীমপলশ্রী রাগে ভর করে একতাল তালে বসন্তের শব্দ বুনে ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কথার মালায় বলেছিলেন, ‘বসন্তে আজ ধরার চিত্ত হল উতলা, …আমার দুটি মুগ্ধ নয়ন নিদ্রা ভুলেছে।’ মাঝে কেটে গেছে একশটি বছর। কেটে গেছে আরো কত কী! তবু এই যেন নিয়তি, তেমনই এক বসন্তের দুপুরে আজও এ দুটি নয়ন নিদ্রা ভুলে, চির নিদ্রায় ডুবেছে। তাই হয়তো শান্তিনিকেতনকে মননে ধারণ করে জীবনের ৯২টি বছর কাটিয়ে দেওয়া সন্জীদা খাতুন সকলের চিত্ত উতলা করে বসন্তেই ভুবন ছাড়লেন।
সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র গবেষক ও সংগীতজ্ঞ। মঙ্গলবার দুপুর ৩.১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন। মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন তাঁর পুত্রবধূ ও ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়েই তাঁর কর্মজীবন শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন।
শুধু কণ্ঠে নয় আন্দোলনে রাজপথেও ভূমিকা রেখেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর সাভারের জিরাব গ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মীও ছিলেন। তাঁরা ভারতের আগরতলা শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। তারপর ‘৭১ এর ৫ মে কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের একতাবদ্ধ করা শুরু করেন।
সন্জীদা খাতুনের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষক হিসেবে। শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর তিনি ইডেন কলেজ, কারমাইকেল কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শেষে অবসরে যান।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার। এর মধ্যে একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি পেয়েছেন। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে।