নির্বাচনের আগেই এআই-নির্ভর ভিডিওতে সয়লাব: গবেষণা

টাইমস রিপোর্ট
4 Min Read
গ্রাপিক্স: এআই/টাইমস
Highlights
  • ‘এই ধরনের কনটেন্ট ডিপফেকের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কারণ, দর্শকরা এ ধরনের ভিডিওতে সাবধান থাকে না।’

বাংলাদেশ আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রচারণার ক্ষেত্রে নজিরবিহীন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আর এখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি ভিডিও কনটেন্টের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে।

বিভিন্ন পেশা ও সম্প্রদায়ের কল্পিত ভোটারদের দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করার ভুয়া বক্তব্য দেখানো এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল নৈতিকতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছে বলে জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব-এর এক গবেষণা।

জুনের মাঝামাঝি এই প্রবণতা শুরু হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা ফেসবুকে এআই-নির্মিত ভিডিও পোস্ট করতে থাকেন। এই ভিডিওগুলো গুগলের ভিও ৩ টেক্সট-টু-ভিডিও টুল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে হিন্দু নারী, রিকশাচালক, পেশাজীবী ও শ্রমিকদের কল্পিত সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছে। তারা সবাই জামায়াতকে সমর্থন করছেন বলেও দাবি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জামায়াত বলেছে, এগুলো তৃণমূল সমর্থকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত নয়। তবে দলের শীর্ষ নেতারা এসব ভিডিও শেয়ার করেছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোও এই প্রবণতায় যোগ দেয়। বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এমনকি সাময়িকভাবে স্থগিত আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও এআই ভিডিও তৈরি করে। কখনো নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে, কখনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ করা হয় এসব ভিডিওতে।

ডিসমিসল্যাবসের এ গবেষণা অনুযায়ী, ৭০টি ভিডিও একত্রে ২ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভিউ এবং ১০ লাখের বেশি রিঅ্যাকশন পেয়েছে।

জামায়াতের এআই প্রচারণা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল ধর্মীয় ও আর্থসামাজিকভাবে বিস্তৃত প্রতিনিধি দেখানোর কারণে। ভিডিওগুলোতে সিঁদুর পরা হিন্দু নারী, হিজাব পরা মুসলিম এবং পেশাজীবীদের জামায়াতকে সমর্থন করতে দেখা যায়, যা দলের রক্ষণশীল ইসলামী ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

কিছু ভিডিওতে জামায়াতকে গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একমাত্র সহায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আর অন্যগুলোতে ধর্মীয় ভাষ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে,‘জান্নাতের টিকিট বিক্রি করছে জামায়াত’।

বিএনপি এবং এনসিপির সমর্থকরা পাল্টা এআই-নির্ভর বার্তা ছড়িয়েছে। একটি ভাইরাল ক্লিপে এক তরুণ ভোটার জামায়াতকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’বলে আখ্যা দেয়। অন্যটি ধর্মীয় রাজনীতিকে বিদ্রূপ করে বলে, ‘ধর্মের বণিকদের ভোট দেবেন না’। এনসিপির সমর্থকেরা তাদের দলকে ‘শাপলা’ প্রতীকের নতুন বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে, কৃত্রিম চরিত্র দিয়ে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত পেজগুলো—যদিও দলের কর্মকাণ্ড স্থগিত—এআই কনটেন্ট ছড়িয়েছে যেখানে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তি দেখিয়েছে, ‘নৌকা’ প্রতীক ছাড়া নির্বাচন অর্থহীন।

ডিপফেকের মতো বাস্তব মানুষের ছবি বিকৃত করার পরিবর্তে  এই ভিডিওগুলো পুরোপুরি কল্পিত চরিত্র নিয়ে তৈরি, যা বিশেষজ্ঞরা ‘সফটফেইক’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

এআই বিশেষজ্ঞ রুম্মান চৌধুরী সতর্ক বলেছেন, ‘এই ধরনের কনটেন্ট ডিপফেকের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কারণ, দর্শকরা এ ধরনের ভিডিওতে সাবধান থাকে না।’

মেটা ও টিকটক-এর নীতি অনুযায়ী এআই লেবেল দেওয়ার নিয়ম থাকলেও, বিশ্লেষণকৃত কোনো ভিডিওতেই কৃত্রিম উৎসের কথা উল্লেখ ছিল না। টিকটক কিছু ভিডিওকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত করলেও, ফেসবুকের সিস্টেম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভোটাররা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা গল্পের ফাঁদে পড়ছেন।

বাংলাদেশে এখনো নির্বাচনে এআই ব্যবহারের জন্য কোনো নিয়ন্ত্রক আইন নেই। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ ধরনের প্রতারণামূলক কনটেন্টের ওপর কড়া নিয়ম এবং লেবেলিং বাধ্যতামূলক।

বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক বলেছেন,’নিয়মিত লেবেলিং এবং ফরেনসিক টুল বাধ্যতামূলক করতে এখনই নীতি প্রয়োজন।’

২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় সামান্য এআই-ভিত্তিক বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা দেখা গেলেও, ২০২৬-এর নির্বাচনী সময়ে দৃশ্যপট পুরো বদলে গেছে। ভিও ৩-এর মতো টুল ব্যবহার করে সহজেই স্বল্প খরচে উচ্চমানের ভিডিও তৈরি করা সম্ভব হওয়ায় এই ‘সিনথেটিক প্রচারণা’ অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ত্রপা মজুমদার বলেন, ‘এই ভিডিওগুলো পুরোপুরি কল্পকাহিনি। এতে যে মানুষগুলোর কথা বলা হয়েছে তাদের অস্তিত্বই নেই। তাই মার্কেটিং বা রাজনীতিতে যেখানেই হোক, এগুলো নৈতিক নয়।’

যদি অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, বাংলাদেশে নির্বাচনে প্রচারণায় কৃত্রিমভাবে তৈরি সমর্থনে সয়লাব হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি (ত্রপা মজুমদার)।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *